চলে গেলেন বহুমাত্রিক বহুস্বরের লেখক, শ্রমিষ্ঠজনের পাশে থাকা মানুষ দেবেশ রায়ঃ তাঁকে বিনম্র শ্রদ্ধা
বরিশালের যোগেন মন্ডলের সঙ্গে তিস্তাপারে দেখা
মণিদা। মণিভূষণ ভট্টাচার্য। নৈহাটি ছেড়ে চলে যান। তিনি বলেছিলেন ঠিকানাটা রাখো। বল্মীকি আবাসন। বাগুইহাটি। ওখানে দেবেশ রায় থাকেন। ওই আবাসনে এলে তোমার ভালো লাগবে। আরও কয়েকজন লেখক সাহিত্যিক থাকেন। এরপর থেকে ওখানে যোগাযোগ করবে।
দেবেশ রায়ই সেই উত্তাল সময়ের কিছু পরে ‘পরিচয়’ পত্রিকার সম্পাদক হয়েছিলেন। সেটা সম্ভবত ১৯৭৯ সাল। আমরা শিয়ালদহ থেকে অফিসে যেতুম পায়ে হেঁটে তখন। বৌবাজার স্ট্রীট অর্থাৎ এখনকার বিপিনবিহারী গাঙ্গুলি স্ট্রিট ধরে। যাবার সময় ডানদিকে পড়তো পরিচয় অফিস। সে পরিচয় অফিস তখন বিকেলের দিকে খুলতো। অফিস ফেরত সেখানে দেখা হয়েছিল প্রথম দেবেশ রায়ের সাথে। ইচ্ছে ছিল ‘পরিচয়’-এ যদি একটি লেখা ছাপা হয়! পরিচয়– সে তো এক ঐতিহাসিক পত্রিকা।
পরবর্তীতে বল্মীকি ভবনে দেখা। মণিদার বাড়িতে গিয়েছিলুম। মণিদা পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলেন। ঘর দেখেই তো হতবাক। বইয়ের পাহাড়। দেবেশ রায়ের সুবিধা ছিল এই তিনি বহু বই সৌজন্যে পেতেন। তিনি আলোচক, সমালোচক ছিলেন তো! তার চেহারায় বিশেষ বৈশিষ্ট্য নিশ্চিত ছিল। দেখলেই সম্ভ্রম জাগে।
প্রথমেই বললেন, মণির সঙ্গে পরিচয় মানেই লেখালিখি তো বটেই, রাজনীতিঘটিত সম্পর্ক আছে নিশ্চয়ই। তা যাই হোক, সাহিত্যের বাঁক, লেখার ধরন নিয়ে অনেক কথা হলো।
” হ্যাঁ, তোমরা তো কবি, তোমাদের তো আবার অন্য জাতও আছে।” তিনি মজা করেই কথাটি বললেন।
তার সম্বন্ধে আমি এইটুকুই বলতে পারি ওই সোজা বাংলার পুরানো চলতি কথা– জ্ঞানসমুদ্র। পৃথিবীর কোথায় কি ঘটছে– রাজনৈতিক, ঐতিহাসিক, ভৌগোলিক তা যাই হোক না কেন, তা তার নখদর্পণে। শুধু তাই নয় বিশ্বসাহিত্যর মোড় নিয়ে তার আলোচনা শুনবার মতো। লিখনশৈলীর সঙ্গে বিশ্বজাগতিক ঘটনা প্রবাহের সংযোগ আছে, তিনি বললেন। খুবই মনোগ্রাহী তার শব্দ প্রক্ষেপণ।
পরে আমি বলি, মণিদার কবিতা নিয়ে কিছু বলুন। মণির সামনে মণির কবিতা নিয়ে বলবো? তিনি বললেন, রাজনৈতিক, সমাজজীবন, পুরাণ, ইতিহাস, কিভাবে উঠে আসে তা মণিভূষণের কবিতা পড়ো, বুঝতে পারবে সহজেই। মণিভূষণ ভট্টাচার্যর শ্রেষ্ঠ কবিতা সমগ্র-র ভূমিকা তিনিই লিখেছেন্ সেই লিখনও এক প্রাপ্তি। উল্লেখ্য, এই কবিতাসমগ্রের জন্য মণিভূষণ রবীন্দ্র পুরস্কারে সম্মানিত হন। সেটা ২০০২ সাল।
দেবেশ রায়ের উত্তর সম্পাদকীয়, আনন্দ বাজার পত্রিকা, আজকাল ও অন্যান্য পত্রিকায় পাঠ করেননি এমন কজন আছেন?
কাঁচরাপাড়া সংলগ্ন কল্যাণী শহরের উল্লেখযোগ্য নাট্য বিষয়ক যে সংস্থা সেটির নাম কল্যাণী নাট্যচর্চা কেন্দ্র। এই নাট্যচর্চা কেন্দ্রের সঙ্গে তিনি নিবিড়ভাবে অন্বিষ্ট ছিলেন। ২০০৪ সালে কলকাতা এ্যাকাডেমি প্রেক্ষাগৃহে কল্যাণী নাট্যচর্চা কেন্দ্রের প্রযোজনা ‘খোয়াবনামা’ প্রদর্শিত হয়। সেখানে নাটক দেখে তিনি অত্যন্ত আপ্লুত হন। উল্লেখ্য দেবেশ রায় নিজে অত্যন্ত নাট্যপ্রেমিক ছিলেন। কলকাতা এ্যাকাডেমিতে প্রদর্শিত এই নাট্যচর্চা কেন্দ্রেরই প্রযোজিত নাটক ‘হারিয়ে যাওয়া মানুষ’ও তিনি দেখেছেন। পরবর্তীতে তিনি এই নাট্যচর্চা কেন্দ্রের সঙ্গে বলতে গেলে প্রায় জড়িয়েই যান। এই সংস্থার অন্যতম নেতৃত্ব সভাপতি ও কল্যাণীর প্রাক্তন পৌরপ্রধান শান্তনু ঝা এবং নাট্যভিনেতা ও নির্দেশক কিশোর সেনগুপ্ত-র সঙ্গে তার হৃদ্য সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল। কিশোর জানালেন,তাদের প্রযোজিত প্রায় সব নাটকই তিনি দেখেছেন। কোনো নাটক তো বার দুইও দেখেছেন।তাদের আমন্ত্রণে তিনি মাঝেমধ্যেই কল্যাণী আসতেন। কলকাতার একাডেমি অফ ফাইন আর্টস প্রেক্ষাগৃহে তার সঙ্গে বসে
নূরুলদীনের সারাজীবন নাটকটি দেখার সৌভাগ্য হয়েছিল আমার। উল্লেখে নিশ্চিত অতিশয়োক্তি হবে না আমার বন্ধু বাগমোড় সংলগ্নবাসী একসময়ের নাট্যাভিনেতা অঞ্চলে সুপরিচিত বাবলু দাশগুপ্তও তার সান্নিধ্য পেয়েছিল।
নাট্যচর্চা কেন্দ্রের যে নাট্যভবন, তাপস সেন-কুমার রায় ভবন ২০১১ সালে উদ্বোধন হয়, সেই অনুষ্ঠানে তিনি অংশগ্রহণও করেন। উল্লেখ্য এই নাট্যভবনটির ভিত্তি প্রস্তর স্থাপন করেছিলেন বহুরূপী নাট্যদলের সেই স্বনামখ্যাত নাট্যাভিনেতা কুমার রায়।
এইভাবে কাঁচরাপাড়া কল্যাণী অধ্যূষিত অঞ্চলে দেবেশ রায় জড়িয়ে গিয়েছিলেন।
‘তিস্তাপারের বৃত্তান্ত’ তো ইতিহাস। এছাড়া ‘তিস্তাপুরাণ’, ‘যযাতির’ তার উল্লেখযোগ্য উপন্যাস। আহ্নিক গতি আছে। মাঝখানের দরজা দিয়ে ‘পশ্চাতভূমি’ পাশে রেখে তিনি ‘পা’ ফেলেছেন এখন অন্তরীক্ষের দিকে ‘যযাতি’র মতো।