আজ বিশ্ব পিতা দিবস। আমাদের তো বাপ-ই বিশ্ব।
অবতক-এর বিশেষ প্রতিবেদন
আমার বাপ, কুনকে, চালভাজা, শসা ও পৃথিবী
তমাল সাহা
সবারই তো বাবা থাকে। আমার বাবা বলে কি কোনো কথা হয়? বাবা তো পিতা। জনক। একটা আজন্ম সুখময় ঋণের খেলা কেন যেন চলতে থাকে আমার মধ্যে! ভাঁড়ার ঘরে একটা পুরনো আলমারি দাঁড়ানো। দামি। সেগুন কাঠের। অনেকদিন থেকে পড়ে আছে। সে আলমারির তাকে খুঁজে পেলাম একটা ফতুয়া। সামনে দুটো পকেট। শুঁকে দেখি পুরানো গন্ধের সঙ্গে বাবার গায়ের সুবাস।
এই আমার বাবা। মাস্টারমশাই! আমার বাবা মানেই এক কুনকে চালভাজা,দু টুকরো শসা, স্থির পৃথিবী,তেরিয়া মেজাজ,পঞ্চাশ টাকা মাইনে বাড়ানোর দাবি আর ইন্সপেক্টরের ছানাবড়া চোখের সক্রোধী কবিতা।আমার বাবা মানেই লোহার পাত থেকে পিস্তল রাইফেল রিভলভারের নল বানানোর কাহিনী। আমার বাবা মানেই মেহগনি কাঠ, রাইফেলের কুঁদো বানানোর আখ্যান। আমার বাবা মানেই মোটা রামায়ণ মহাভারত ও পিস্তলের সম্পর্ক।
আমার বাবা ভোরাই ভ্রমণে বলেছিল, মাটি ও আকাশের মধ্যে কে বড়, বলো? আমি বাবার দিকে চেয়ে থাকি। বাবা বলে মাটিই বড়। যতদূর মাটি ততদূর আকাশ। মাটি ছাড়া আকাশের গতি নেই। খেয়াল করেছো আকাশ মাটির দিকে বিশাল কড়াইয়ের মত উপুড় হয়ে আছে। আকাশের গায়ে থাকে তাই কী! রোদ জ্যোৎস্না যতক্ষণ না আকাশ থেকে মাটিতে ছড়ায় তার দাম নেই। মাটিতে পা রেখেই তো তুমি নক্ষত্রের আলো দেখো, জ্যোৎস্নায় ভেজো। বড় হয়ে জীবনানন্দ পড়লে:আকাশ থেকে মাটিতে নক্ষত্র পতনের নীরব শব্দ শুনতে পাবে। বৃষ্টিতে ভেজার ভালবাসার সন্ধান পাবে তুমি বড় হয়ে। আকাশ থেকে যতক্ষণ না মাটিতে ঝরে পড়ছে, বৃষ্টির সুখ নেই। বাবা আমাকে পাখির নীড়ের মতো চোখের চিত্রকল্প সহজ করে বুঝিয়ে দিয়েছিল। বঙ্কিমচন্দ্র কেন ঋষি, রামকৃষ্ণ কেন পরমহংস, নির্লিপ্ত হয়ে বলতে পারতো আমার বাবা। মহাভারত রামায়ণ গীতা বেদ সত্য মিথ্যার প্রসঙ্গ কোনদিনই বাবা তোলেনি। এদের নামকরণ এমন কেন তা বলেছিল, মহাভারত অর্থ আসলে কি। বলেছিল, এসব মানো আর না মানো সমাজ চিত্র, রাজকীয় শোষণ,সমাজ ব্যবস্থা, নারীদের প্রতি অবহেলা, কূটনীতি, সমাজ প্রকৃতি সম্পর্কে তোমার ধারণা বিচার-বিশ্লেষণে সহায়ক হবে। আর ওই যে বলো তোমরা দলিত শ্রেণী,পিছড়ে বর্গ তার ধ্যান ধারণাও তুমি এর মধ্যে পাবে। এসব তোমার লেখায় লাগবে।
লেনিন-মাওয়ের বই পড়তে দেখে বাবা আমায় বলেছিল, পঠন আর প্রয়োগ দুটি শব্দের মধ্যে পার্থক্য জানো? বোঝো? প্রয়োগই আসল। তুমি লেনিন মাওয়ের উদ্ধৃতি মুখস্থ করে লেনিন-মাওয়ের রচনা খণ্ডের কত পৃষ্ঠায় ওই অনুচ্ছেদে এই লেখা আছে বলে পাণ্ডিত্য দেখাতে পারো, মানুষ ভাববে লোকটা কত জ্ঞানী, কত কিছু জানে কিন্তু ও তো তোমার মুখস্থ ভাষণ! তোমার ভাষণ সর্বস্ব চাল চলন যতই তোমাকে লোকে ভালো বলুক প্রয়োগটা তোমাকে শিখতে হবে, আয়ত্ত করতে হবে। সাধারণ মানুষ তো তোমার ওই কথার মোহজালে আবদ্ধ হলো। পঠন, প্রয়োগ এবং নিজস্ব সক্রিয়তার দৃষ্টান্ত রেখেছিলেন লেনিন- মাও তাই তারা নেতা। নেতা মানে যিনি এগিয়ে নিয়ে যান।
আমার বাবা বলেছিল গোলাপ ডালিয়া রডোডেনড্রন জিনিয়া এসব লিখবে না। আপেল কমলা গরিবরা খেতে পায় না। তুমি লিখবে কুল,পেয়ারা,বৈঁচি ফল।এসব সাধারণ মানুষ খায়। এসব দিয়ে উপমা চিত্রকল্প আঁকবে। গোলাপের কুড়ির বদলে তুমি তোমার নারীর কেশদামে পলাশ গুঁজে দিতে পারো। হাতে কৃষ্ণচূড়ার পাপড়ি তুলে দিতে পারো। নয়নতারা, কাঠ মালতী, কনকচাপা মাধবীলতা ফুলগুলি ব্যবহার করবে লেখায়। যত যত ভালো গাছের নাম শোনো বাংলায় এসবই রবীন্দ্রনাথের দেওয়া মনে রেখো। অমলতাস, সোনাঝুরি, অলকানন্দা, বাগান বিলাস কত সব!
আর শোনো নারীদের মূল্য বুঝবে। পৃথিবীতে কটা পুরুষ গাছ তুমি চেনো? সব গাছেই দেখবে ফুল ফোটে, ফল হয়। ফুল না ফুটলে ফল না ধরলে গাছের সৌন্দর্য বাড়ে না।
লাউ গাছ দেখেছো? তাতে লাউ ঝুলতে দেখেছো? লাউয়ের ওজনের সমান একটা ইট ওই লাউ গাছে বেঁধে দাও, দেখবে লাউ গাছ ওই ভার বহন করতে পারছে না। তোমার মা তোমার ওজন দশ মাস বহন করেছিল। ওই ওজনের একটা ইট কি দশ মাস বহন করতে পারতো?
একে বলে জাতক জননী সম্পর্ক, রক্ত ও স্নেহের বন্ধন। এর থেকেই বাৎসল্য রস ও ভালোবাসার হরমোন তৈরি হয়।
আমি ভাবি, আমার বাবার সেই এক কুনকে চালভাজা দু’টুকরো শসার জীবন। আমাদের বাড়িতে একটা বেতের ও একটা পেতলের কুনকে ছিল।বাবা বলেছিল, কুঞ্চি থেকে কুনিকা, কুনিকা থেকে কুনকে শব্দটি এসেছে। কুনিকা মানে হলো শস্যমাপক পাত্র বা রেক। পেটের দানাপানি মাপার যন্ত্র। এক কুনকে মানে আট মুষ্টি। আর মুষ্টি তো হিম্মত, পেশিশক্তি।
কিন্তু জীবন মাপার যন্ত্র কি? তুমি এই ভূমিতে কি করছ সেটা। সেটার পরিমাপ তুমি দেখতে পাবে না। তুমি চলে যাবার পর মানুষ তাদের তৈরি দাঁড়িপাল্লায় তোমাকে মাপবে!
আমি চাকরি পাবার পর বাবাকে বাটা কোম্পানির একজোড়া ক্যুয়ো ভাদিস জুতো– পেছনে বেল্ট বাঁধা স্যান্ডেল কিনে দিয়েছিলাম। বাবা বলেছিল, ক্যুয়ো ভাদিস মানে জানো? কোথায় চলেছো!