অবতক-এর বিশেষ প্রতিবেদনঃ

লকডাউন ও বীজপুরের পটুয়াপাড়া

পর্ব-৪

আমরা নাকি শিল্পী! মাথায় নাই চুল, গালে বড় জুলপিঃ শ্যামল পাল

পুজোর মাধুকরী ব্রত নিয়েছি আমি। কাঁধে সেই যেন কাঁথা ফোঁড়ের লাউ-থলে। একটু একটু করে সঞ্চয় করছি মাটির মানুষের জীবনের গল্প। কি করে হাত দিয়ে এমন করে কাদামাটি ছানে মানুষ!কেমন করে পরতে পরতে কাঠামোয় মাটি লাগায়। আমি দেখি আর ভাবি আর হাঁটতেই থাকি জিপি রোড ধরে উত্তর দিকে। পৌঁছে যাই সেই পুরাতনী রথতলার দিকে।

মা তো ঘরের মেয়ে। সে মেয়ে তো সহজ সরল নয়। যদিও উমা নামটি খুবই নরম নাম। ‌ মেয়ে যন্ত্রণায় নাকি কাতরেছিল কোন এক কারণে,আর তখনই উচ্চারণ করেছিল উহঃ মা…তা থেকে নাকি তার নাম হয়ে গেল উমা। সেই যন্ত্রণাকাতর উমা তার শেষের বর্ণ মা। মাটি শব্দে সেই শব্দটি প্রথম। সেটাই এখন আমাদের সর্বজনীন সার্বজনীন মা।

মাকে দুর্গতিনাশিনী রাজকীয় অগ্নিকন্যায় রূপান্তর করছেন শ্যামল পাল। কল্যাণী রথতলার কাছে জিপি রোডের ধারে। মৃৎশালার নাম– বাবা লোকনাথ শিল্পালয়। সাইনবোর্ডে এমনই তো লেখা। আর তার নাম ও মোবাইল নম্বর। পটুয়ার ঘরে ঢুকতেই দেখি পটুয়া
মা ছেলে ও মেয়ের মুখ ছাঁচে ফেলে হাতে মাটি টিপে টিপে গড়ে তুলছেন, নিখুঁত করতে চাইছেন মাতৃ মুখ। পাশে মেঝেতে অল্প রোদ। অনেক তৈরি হওয়া মুখ রোদ মাখছে মুখে। আমি বলি, ও শিল্পী মশাই! অসুরের ছাঁচ নেই? উনি মুচকি হাসেন অসুরের মুখ কি আর ছাঁচে ফেলা যায়? অমন দুর্দমনীয় অসুর তাকে বাগে আনা সহজ? অসুরের ভঙ্গিমাই আলাদা– কখনো মানুষরূপী কখনো মহিষরূপী। তার চুলের কায়দাখানাও অনেক কিসিম।

তো বাজার কেমন?চটজলদি জবাব, লকডাউন। বড় ৩৫টা বানিয়েছিলাম। তারমধ্যে ৪টে বায়না হয়েছে মাত্র। ‌ বাকিগুলো ঢ্যাঙ্গা হয়ে দাঁড়িয়ে আছে, ওই দেখুন দূরে। এতদিনে মাকড়সাও জাল বুনেছে, দেখুন মায়ের গায়ে। ২০টা ছোট বানাতে বাধ্য হলুম। বড় প্রতিমা কেউ নিতে চাইছে না। ১৬টি ছোট প্রতিমার বায়না হয়েছে।একটা কলকাতার ট্যাংরায় যাবে। প্রতিবারই যায়। ‌ কতজন কর্মচারী আছে? ৮ জন ছিল, লকডাউনের আগে। এখন তিনজন। একটা বড় ঠাকুর কল্যাণীতে যাবে।

আচ্ছা! সেই ঘোষ বাড়ি রথতলার বনেদি বাড়ি। ‌ ওই প্রতিমা তো আমি বিগত ৪০ বছর ধরে বানিয়ে আসছি। সঙ্গে ছেলে থাকে। ৩৫০-৪০০ বছরের পুজো। এই প্রতিমা গড়বার একটা আলাদা আনন্দ পাই। বাড়িটার পুরাতনী এখনো দেখনদারি। ওখানে গেলেই অন্য একটা জগতে চলে যাই।

বাজার কেমন বুঝছেন? বাজার না তো বেজার! গলার স্বর ওঠানামা করছে শ্যামল বাবুর। পুঁজি তো বড় প্রতিমাই খেয়ে নিয়েছে। কপালে হাত। সেই পুঁজি বুঝি জলে গেল। কারণ ঠাকুর তো আর বিক্রি হবে না। বড় ঠাকুর তো আর কেউ কিনবে না। পাটের সুতো ছিল কেজি ৮৫ টাকা। এখন ১২৫ টাকা। বিচালি ছিল ৪৫ টাকা,এখন ১৬০ টাকা। বেলে মাটি ২৭০ টাকা। রিক্সা ভ্যান গাড়ি এঁটেল মাটি ১ হাজার টাকা প্রতি ২৫ বস্তা।
এক মেটে দো মেটে তিন মেটে তো হয় প্রতিমার,আমি জিজ্ঞেস করি। তিনি পরিষ্কার কথা বলেন। কলকাতার মাটি আমি কিনিনা। ওই মাটি কিনতে গেলে শিল্পী আর আমার শিল্পের দফারফা। প্রতিমার দর কত পড়বে জানেন? আমি এক মেটে দো মেটে করি। মিথ্যা কথা বলবো না, তিন মেটে আমি করিনা। তাই কলকাতার মাটি আমার লাগে না। গতবার ৫০টা বড় বানিয়েছিলাম। নিচের দাম ছিল ৫০ হাজার টাকা, উপরের দাম ছিল ১ লক্ষ টাকা পর্যন্ত। এবার ছোট প্রতিমার দামই নেমে গেছে ৬ হাজার ৭ হাজার টাকায়। গতবার দাম ছিল ১৪-১৫ হাজার থেকে শুরু।

শ্যামল পাল এবার উত্তেজিত হয়ে বলেন,আমরা নাকি শিল্পী। তারপর তীব্র তির্যকে বলেন,মাথায় নাই চুল গালে বড় ঝুলপি।আমরা নাকি শিল্পী! আমরা নাকি শিল্পী!