আহা রথ
তমাল সাহা

রথ চলমানতার প্রতীক। যুযুধান রথ দ্বৈরথের চেতনা আনে।

১৮৬২ সালে রাধাবল্লভের রথযাত্রার আয়োজন করা হয় বঙ্কিমচন্দ্রের নৈহাটীর কাঁঠালপাড়ার বাড়িতে। সাহিত্য সম্রাট বঙ্কিমচন্দ্র নিজেও এই রথের আয়োজনে উদ্যোগী ভূমিকা গ্রহণ করেন।

১৮৬২ সালেই আষাঢ়স্য রথস্য দিবসে লৌহবর্ত্মে শিয়ালদহ থেকে রানাঘাট পর্যন্ত যাত্রীবাহী লৌহরথ চলাচল শুরু করে।

১৮৭৫ সালে কাঁঠালপাড়ার রথযাত্রাই রাধারাণী উপন্যাসের উৎস মুখ। এই বছর রথের মেলার ভিড়ে এক বালিকা হারিয়ে যায়। বঙ্কিমচন্দ্র নিজেও বালিকাটির সন্ধানে নেমে পড়েন। সেই ঘটনার দু মাস পরেই রাধারাণী উপন্যাসের জন্ম। বঙ্গদর্শনে উপন্যাসটি প্রকাশিত হতে থাকে।

রথযাত্রার ভাবনা মাথায় না থাকলে কি রবীন্দ্রনাথ কালের যাত্রা বা রথের রশি নাটকটি লিখতে পারতেন?
রথের ভাবনাকে মাথায় রেখে রবীন্দ্রনাথ অনেক পদ্য গদ্য প্রবন্ধ নির্মাণ করেছেন। রথের চিত্রায়িত চেতনাতেই রবীন্দ্রনাথ লেখেন কৃপণ কবিতাটি– তুমি যখন চলেছিলে তোমার স্বর্ণরথে… বা উড়িয়ে ধ্বজা অভ্রভেদী রথে… অথবা রথযাত্রার গদ্য এবং রথের রশির পদ্য। কণিকার সেই ভক্তভাজন– রথযাত্রা লোকারণ্য মহা ধুমধাম… আমাদের সুপরিচিত সেই ভাবসম্প্রসারণ লেখার কথা কার না মনে আছে! পথ, রথ,মূর্তির তাৎপর্য এবং প্রকৃত অন্তর্যামী কোথায় থাকেন, তা আমাদের কাছে তুলে ধরেছিলেন।

রথ বঙ্কিমচন্দ্রের হাতে প্রেমের উপন্যাসের জন্ম দিয়েছিল আর রবীন্দ্রনাথের হাতে তা হয়ে উঠেছিল শ্রেণিচেতনা জাগরণের ভাবনা।

এবার নৈহাটী কাঁঠালপাড়ার রথ ১৬০ বছরে এবং শ্রীরামপুর ও রিষড়ার মধ্যবর্তী অঞ্চল সংলগ্ন মাহেশের রথ ৬২৬ বছরে পদার্পণ করল।
এবারে লেখা দুটি নতুন শব্দসজ্জা

১) রথের মেলা

বঙ্কিমচন্দ্র না পড়লে আমি কেন ক’জনইবা রথের মেলা ভালোবাসতো আমার সন্দেহ জাগে।

রথের মেলা থেকে ভালবাসার জন্ম হয়?

মাহেশের রথ– পাঁপড়ভাজার আকর্ষণী ঘ্রাণ, তালপাতার ভেঁপুর শব্দ, বৃষ্টির সঙ্গে বনফুল মালার গন্ধ, একটি মানুষের হৃদয়ের ধ্বনি মিলেমিশে রথের মেলা হয়ে যায়।
তখন পুরীর রথের চেয়েও মাহেশের রথ অনেক উঁচু আকাশ ছুঁয়ে যায়!

অন্ধকার, পিছল পথ, হাতের উপর হাতের উষ্ণতা, পাশাপাশি হাঁটার সান্নিধ্যে অন্য রথ চলতে থাকে…

মা, রাধারাণী, অচেনা মানুষটি, আলো জ্বেলে মুদ্রাটির স্পর্শ এবং তার দিকে নির্নিমেষ তাকিয়ে থাকা– জীবন রথচক্র হয়ে ঘুরতে থাকে!

২) নবরথ

শ্রবণ করো হে নরনারীগণ
শ্রবণ করো হে সর্বজন!
রথ তো প্রাচীন গাথা
নবরথ কথা করিনু বর্ণন।

রথ প্রতীক মাত্র
সে তো সভ্যতার গতিশীল চক্রযান।
রথীরা চালনা করে রথ
জেনে রাখো কাছি-রশি শ্রমশক্তি,
টেনে চলে শক্তিমান মজদুর পালোয়ান।

জগন্নাথ দেবতা নহে, প্রতীক পথপ্রদর্শক।
সেনাপতি নেই, সে যুদ্ধ নাস্তর্থক।
সমুদ্রগর্জন ছদ্মবেশী রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসে কম্পমান সুভদ্রা শঙ্কিত
রক্ষা করো নারীদের পার্শ্বে থাকো অবিরত।
হলস্কন্ধে বীরভদ্র বলরাম,সঙ্গে রাখো তাকে
রাষ্ট্রীয় যুদ্ধে করো হে শক্তি সংহত।

শোনো হে উপস্থিতজন রথের মেলায়–
জনগণই শক্তি
তোমরা নহে শুধু দর্শক,সহযোদ্ধা প্রতিনিয়ত।

যুযুধান রথ, চূড়ায় উজ্জ্বল পতাকা উড্ডীন
যুদ্ধভেরী বাজে,
সম্মুখে সুনিশ্চিত রঙিন বিজয়ের দিন।