রবীন্দ্রনাথ এবারও এলেন
২৫ শে বৈশাখে কিন্তু করোনার বাতাসে। মহামারী,খাদ্যত্রাণ বন্টন, মৃত্যু ও লাশ গায়েব দেখলেন মহাসমারোহে।

এবারের রবীন্দ্রনাথ
তমাল সাহা

এইবার রবীন্দ্রনাথ এলেন ৮ মে।
তবে দিনটি ২৫শে বৈশাখই ছিল।

বিশ্বজুড়ে কোভিড-১৯ এর
মহাক্রান্তিকাল।
তিনি মুখোশ এঁটে বের হতে
বাধ্য হলেন।
ছাদে মর্নিংওয়াক করছিল যারা
সকলেই বলে উঠল,
রবি ঠাকুরকেও মুখে আঁটতে হল মুখোশ!
দেখো, তিনি বেরিয়ে পড়েছেন।

রবীন্দ্রনাথ দেখলেন,
ভেঙেছে দুয়ার এসেছে জ্যোতির্ময়–
গাইতে গাইতে প্রভাতফেরী নেই।
ট্রাফিক সিগনালেও আজ রবীন্দ্রসঙ্গীত বাজছে না।
গাড়ি-ঘোড়া চলাচল বন্ধ।
ডিভাইডারের মাটিতে অনুচ্চ কৃষ্ণচূড়ার ডালে দুলে উঠলো ফুলেরা,
আরে! ওই দ্যাখো,রবীন্দ্রনাথ যাচ্ছেন,
লকডাউনে নেমেছেন রাস্তায়।

জোড়াসাঁকো পেরোতেই দেখলেন
চিত্তরঞ্জন এভিনিউ শুনশান, ফাঁকা।
পুলিশি টহল চলছে…
দোকানপাট বন্ধ,জনহীন পথ।
মে ডে গিয়েছে কয়েক দিন আগে।
কোনোক্রমে গড়ে তোলা
শহীদ বেদীতে লাল পতাকা উড়ছে।
তার মনে পড়ল রক্তকরবীর কথা।
আর পার্সনস, স্পাইজ, এঞ্জেল,
ফিশারের মুখ মনে পড়ল।

তিনিতো আইনস্টাইন মুসোলিনি গান্ধিজি নজরুল নেতাজি জহরলাল দেশবন্ধু
কত নেতার সঙ্গে মিশেছেন।
এবার দেখলেন ছোট-বড় নেতাদের।
তারা ত্রাণসামগ্রী বিলি করছেন। ‌
সার সার ভুখা মানুষ
গোল গন্ডির ভেতর দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করছে,
কতক্ষণে পাবে পেটের দানাপানি।

তিনি মেডিকেল কলেজ, নীলরতন, এসএসকেএম, আর জি কর ঘুরে দেখলেন। চিকিৎসক ও নার্সদের দিকে তাকালেন, প্রতি নমস্কার জানালেন।
পরিবেশ-পরিস্থিতি পরিকাঠামো দেখে
চুপ করে রইলেন। ‌

কয়েকজন স্বনামধন্য চিকিৎসক ফিসফিস করে নিজেদের মধ্যে বললেন,
রবি ঠাকুরকে বলবো, করোনায় মৃত্যুর সংখ্যা কম দেখানো হচ্ছে।
টেস্ট হচ্ছে না, লাশ গায়েব হয়ে যাচ্ছে।
উনি বিশ্বকবি, আন্তর্জাতিক খ্যাতি,
উনি এর একটা বিহিত করতে পারবেন।

একজন অভিজ্ঞ বয়স্কা চিকিৎসক বলে উঠলেন, উনি কিছুই করতে পারবেন না।
উনি সমর্পণের ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে আছেন,
হাত দুটো পিছনে জড়ো করে।

তিনি মনে মনে আউড়ে গেলেন
এন কোভিড-১৯! শব্দটি এর আগে শোনেন নি।
হঠাৎ কী যেন মনে হলো তার!
পরিযায়ী শ্রমিকদের মতো হাঁটার দ্রুততা বেড়ে গেল।
জোড়াসাঁকোর মানুষ তিনি। কলকাতার সব পথঘাট তার চেনা। সোজাসুজি এম আর বাঙ্গুর হাসপাতালে গিয়ে লাশকাটা ঘরে ঢুকলেন।
নিথর নীরব রবীন্দ্রনাথ।
এতো মজুত লাশ! কেন? দাহ হবে কবে কোথায়?
হিরন্ময় রোদ গেল সরে। মেঘলা হয়ে উঠলো আকাশ। পঁচিশে বৈশাখের বাতাস কবির কানের কাছে এসে দাঁড়ায়।বলে, লাশ তো গায়েব হয়ে যাচ্ছে গুরুদেব! —গায়েব!
পরিবারজনের হাতে ডেডবডি দেওয়া হচ্ছে না। জানানো হচ্ছে না। গোপনে রাতের অন্ধকারে ধাপার মাঠে পুড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে। — চলো তো যাই।
না, গুরুদেব আপনার যাওয়া ঠিক হবেনা।
দীর্ঘশ্বাস ফেললেন রবীন্দ্রনাথ।

তিনি বেরিয়ে পড়লেন, দেখলেন
অদ্ভুত সব ফ্লেক্স রাস্তাজুড়ে টাঙানো।
অনুপ্রেরণা, বাংলার গর্ব
কত কী হাবিজাবি লেখা!
তিনি বিড়বিড় করে বলতে থাকলেন,
বঙ্গোপসাগরীয় উপত্যকার
এ কী ভাগ্যরেখা!
আমার সোনার বাংলা গানটির লাইন
তাঁর স্মরণে এল।

রবীন্দ্রনাথ বাড়ি ফিরে গেলেন।
আজ আর লিখতে বসলেন না‌।
অসহায় হেসে কবিতা বললো,
ও রবি ঠাকুর! আজ তোমার জন্মদিন। ‌
আজ এমন শুকনো মুখে বসে আছো কেন?
তোমার বুঝি মন খারাপ?