আজ ২৫ জুলাইঃ এক বিশেষ কবি-যোদ্ধাকে স্মরণ
কবি মুরারির লাশ পড়ে রইল জেলখানার ময়দানে
তমাল সাহা
গাঙ্গেয় উপকূল তখন লিখছে ইতিহাস। সত্তর দশকে তরাইয়ের বিদ্রোহের স্ফুলিঙ্গ বিস্তীর্ণ হয়ে বুকে বুকে দাবানল হয়ে জ্বলছে। এতো কবি কেন সশস্ত্র হতে চায় কেউ কি জানে?
কবি মুরারি মুখোপাধ্যায় হাতে যার কলম, সে কলম রেখে এখন অস্ত্র ধরতে চায়, মিশে যেতে চায় মানুষের ময়দানে।
চলে গেল গোপীবল্লভপুর- বহড়াগোরার পাহাড়ি এলাকায় কৃষকদের সংগঠিত করতে। যার হাতে ছিল কলম সে এখন কাস্তে হাতে কিষাণের সঙ্গে ঘুরে বেড়ায়।
শেষ পর্যন্ত গ্রেপ্তার হয়ে গেল। কবি চলে গেল জেলখানায়। প্রথমে জামশেদপুর জেলখানা। পরে আরো বড় জেলখানা হাজারিবাগ সেন্ট্রাল জেলে পাঠিয়ে দেওয়া হলো তাকে।
কবি তো বীর,আগুনখোর। জেলখানা কি তাকে ধরে রাখতে পারে? চাদর পেঁচিয়ে পেঁচিয়ে পৃথিবীর দীর্ঘতম দড়ি বানায় যাতে জেলখানার সুউচ্চ প্রাচীর টপকে পালিয়ে যেতে পারে।
রাত্রির পাহারাদার পুলিশের সতর্ক চোখ টাওয়ার থেকে টর্চের আলোয় চতুর্দিকে ঘুরে বেড়ায়।
কবি তো পালাচ্ছে– দেখতে পেয়ে পুলিশ গুলি ছুড়তে থাকে, তারপর ধরে ফেলে কবিকে।
২৫ জুলাই,১৯৭১ সে কী বেধড়ক লাঠিপেটা!
কবি মরে যায়। তখন কবির কবিতা বাতাস কাঁপায়—
চাঁদ নদী ফুল তারা পাখি/ দেখা যাবে কিছুকাল পরে/ কেননা এ অন্ধকারে শেষ যুদ্ধ বাকি/ এখন আগুন চাই আমাদের কুঁড়েঘরে।
তাঁকে শ্রদ্ধাতর্পণে আমার দুটি অক্ষরসজ্জা
এক)
জেলখানা ও কবির লাশ
কবিরা কি না পারে!
গ্রেপ্তার হতে পারে
জীবন কাটাতে পারে কারাগারে
দাঁড়াতে পারে ফায়ারিং স্কোয়াডের সামনে
পায়ের নিচে পাটাতন সরে যায়
ঝুলতে পারে ফাঁসিতে
জল্লাদের শক্তিমান রজ্জুর টানকে সে কী ভয় পায়!
এই কবি লড়াকু বড়
প্রতিমুহূর্তে চায় রাষ্ট্রের মুখোমুখি যুদ্ধ।
তাকে কি করে রাখা যায় কারারুদ্ধ?
নিজের হাতে পাকায় চাদরের পর চাদর
পাকিয়ে পাকিয়ে দীর্ঘ সে দড়ি।
কারা প্রাচীর টপকাতেই হবে
মানুষের পাশে থাকা ভীষণ জরুরি।
এতো পলায়ন নয়, চেতনার জাগরণ
কারারক্ষীদের সঙ্গে দুর্ধর্ষ রণ।
নৃশংস সে কী রাষ্ট্রীয় লাঠিপেটা!
চক্রব্যূহে অভিমন্যু কবি—
কি আর করতে পারে,কলম সম্বল তার
সে কী এমন কেউকেটা!
ডানপিটে দেহটি তখন শুধু মাংসপিণ্ড—
রাত্রির স্তব্ধতা খণ্ড বিখণ্ড
আকাশ কান্না বিধুর, অসহায় রাতের তারা
মাটিতে গড়ায় কবির উষ্ণ রক্তধারা…
কলঙ্কিত চাঁদ নিষ্প্রভ হয়ে পড়ে
বাতাসের তোলপাড় হাহুতাশ।
জীবন মৃত্যুর সঙ্গে পাঞ্জা লড়ে
মাটিতে পড়ে থাকে কবির লাশ।
দুই)
ব্যতিক্রমী
চাঁদের বদলে সূর্য চেয়েছিল কবি
চোখে আঁকা ছিল সূর্যস্নাত পৃথিবীর ছবি।
পাখির বদলে কবি চেয়েছিল ঝড়
চেয়েছিল অগ্নিকোণে অশনি ঘনাক ভয়ঙ্কর।
ফুলের বদলে কবি চেয়েছিল অগ্নিক্ষরা বজ্র
শ্রেণিশত্রুর সঙ্গে সম্মুখ সমর তো অনিবার্য।
নদীর বদলে কবি চেয়েছিল বন্যা
প্রেমিকাকে বলেছিল,
সামনে এসে দাঁড়াও অগ্নিকন্যা।
এইতো ছিল কবির সামান্য ইচ্ছে—
তাই রাষ্ট্রীয় হেফাজতে
কবি মরে গেল জেলহাজতে।
হাতে ছিল তার কলমের হাতিয়ার
অধিকার, মানুষের অধিকার।
আর চেয়েছিল সবাই যা চায়
ভালোবাসা- মাত্র চারটি অক্ষর।
যুদ্ধ আগুন চেয়েছিল কবি
বিপ্লব ছিল স্বপ্নের স্বয়ংবর।