কাঁচরাপাড়ার কারখানা এবং সেই বিশ্বকর্মা পুজো
তমাল সাহা
অবতক-এর বিশেষ প্রতিবেদনঃ
ফেলে এসেছি কাঁচরাপাড়ার সেইসব মায়া মধুর বিশ্বকর্মা পুজোর দিনগুলি রেল কারখানার বিশাল চত্বরের ভেতর। কাঁচরাপাড়ার কারখানা– রেল ওয়ার্কশপ,সে তো অনেক কাণ্ডকারখানা! লোহালক্কর, তামা-পেতল, ফার্নেস, ঢালাই ঘর, করাত ঘর এলাহি কারবার। শপ মানে দোকান, ওয়ার্কশপ মানে কারখানা। সে অনেক গল্প। দীর্ঘদেহী পাঠান শ্রমিক, বেঁটেখাটো চীনা মিস্ত্রি,কত নিরক্ষর মানুষ অথচ ঘামে ভেজা শরীর-কড়া পড়া হাত কত মেহনতি! তখনকার সময় মানে ১৮৬৩ সাল– সে তো কবেকার কথা!
১৮ থেকে ২০ হাজার পেশীবহুল হাত তখন চালাচ্ছে মেশিন পত্তর। দুরন্ত বেগে চলছে এই কারখানা। লোকো শপ ভেঙে তৈরি হলো ক্যারেজ শপ, ওয়াগান শপ। লোকোতে ১৫টি, ক্যারেজ, ক্যারেজে ১৫ টি শপ মিলিয়ে মোট ৩০ টি শপ। কাম আর কাম।লোকে গমগম। চলছে ট্রেড ইউনিয়ন গড়ার কাজ। দুনিয়ার মজদুর! এক হো।
কারখানার সে কী কর্মযজ্ঞ! স্টিম ইঞ্জিন- মালগাড়ি -কাঠের বগির মেরামতি,আর বিশ্বযুদ্ধের সময় যুদ্ধবিমান মেরামতি। সেসব এখন ইতিহাস।
রেল কারখানা মানে যেন আমাদের মা। একটা আঁতুড় ঘর। কারখানা থেকে জন্ম নিচ্ছে সৃজনশিল্পীরা।ঘেমো শ্রমিক তার আবার সাংস্কৃতিক চেতনা! ফুটবল টিম ,হকি টীম,অ্যাথলেট,
ক্রীড়াবিদ তৈরি করো।তৈরি তৈরি করো নাট্যকর্মী।কত সব কৃতীদের জন্ম দিয়েছে এই কারখানা। পরাধীন ভারতবর্ষে এখান থেকে ইউরোপিয়ান ফুটবলার পর্যন্ত বার্লিন অলিম্পিকে যোগ দিয়েছে। হিটলারের সঙ্গে করমর্দন করেছে। সেটা সম্ভবত ১৯৩০ সাল। রেলওয়ে ওয়েলফেয়ার উইকের জন্য সাংস্কৃতিক প্রতিযোগিতায় বিচারক হয়ে আসতে হয়েছে কাজী নজরুল ইসলামকে সেই ১৯৪০ সালে। বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়কে তুলে ধরতে হয়েছে কারখানার ভোঁয়ের শব্দ সেই ‘খুঁটির দেবতা’ গল্পে। আর সত্যজিৎ রায়কে ‘পটল বাবু ফিল্মস্টার’ গল্প বানাতে হয়েছে কাঁচরাপাড়ার শ্রমিক কর্মচারীকে নায়ক করে। সে এক গল্প বটে!
থাক সেসব। প্রায় ১৫০ একর জমির উপর এই কাঁচরাপাড়া কারখানার বিশাল চত্বর। তখন ৩০টি বিশ্বকর্মা পুজো তো হতোই। ৩০টি শপে। এছাড়া পুজো হতো হালিশহর কাঁচরাপাড়া এই দুই স্টোরে। ফায়ার ব্রিগেড স্টেশনেও পুজো হতো। বিশ্বকর্মা বলে কথা, সে কী জাঁকজমক! রঙিন কাগজের নিশান ,আমপাতা-গাঁদাফুল-শোলার কদম ফুল নারকেল দড়িতে একসঙ্গে বেঁধে চেন তৈরি করো। সেই চেনে সেজে উঠেছে সব শপের মণ্ডপ। মেশিনপত্র যন্ত্রপাতি সব সাফসুতরো তেল চকচকে ।মেশিনের গায়ে মেটে সিঁদুরের বড় বড় টিপ। কোথাও স্বস্তিকা চিহ্ন।
শপে দাঁড়িয়ে আছে বিশ্বকর্মা কোথাও হাতির পিঠে হেলান দিয়ে, কোনো বিশ্বকর্মা আবার হাতির সওয়ার, হাতে দাঁড়ি পাল্লা আর সেই দমাদম পেটানোর হাতুড়ি।
সব শপই সেজে উঠেছে কারিগরদের হস্তশিল্পের কারিগরিতে। শপের চত্বর কেউ সাজিয়েছে নিজেদের হাতের শৈলীতে তৈরি বড় বড় কালো কুমিরের মডেল দিয়ে,কেউ সাপ বানিয়েছে– সে আকারে বিশাল। কেউ লোহা লক্কর ঝালাই করে বানিয়েছে হাতী, কেউ বানিয়েছে উট। এই ছিল সব দেখবার মতো প্রদর্শনী।
এই সেই একদিন বিশ্বকর্মার পুজোর দিন কারখানা সর্বজনীন মুক্ত– সকলের জন্য খোলা। শ্রমিকরা পরিবার নিয়ে ঢুকে পড়ে কারখানায়। পিতা প্রজন্মদের দেখাচ্ছে তার কর্মস্থল। তার সঙ্গে দিচ্ছে তার কারিগরির বর্ণনা, চেনাচ্ছে মেশিন পত্তর। রেলপথে বাইরে থেকেও আসছে মানুষজন কারখানা দেখতে। এই শহর অধ্যুষিত গ্রামীণ মানুষ চোখ ভরে দেখছে এশিয়ার বৃহত্তম কারখানা। তাদের ঝোলা প্রসাদে পরিপূর্ণ। তাতে কি আছে, ভেজা ছোলা, আখ- কলা- আপেল-শশার টুকরো, কমলার কোয়া,খেজুর– সে হরেক রকমের প্রসাদ। এই আনন্দ উৎসবে কোনো কোনো শপে বসতো কাওয়ালী গানের আসর।
কারখানার বাইরে মেলা বসে গেছে। হরেক কিসিমের জিনিস বিক্রি হচ্ছে সেখানে। খেলনা বেলুন গেরস্থালির টুকিটাকি। সামনে পুজো ক্যাপ, বন্দুক কত কী! শপের ঠাকুর দেখতে দেখতে আমাদের পদযুগল ধুলো মলিন একেবারে কালো হয়ে গিয়েছে। আমাদের হাতে ওই চাবি পটকা ফাটানোর জন্য বড় বড় নাট বল্টু– মোমছাল আর গন্ধক মিশিয়ে সেই বারুদ ওই বল্টু ফুটো করে তার মধ্যে ভরে দিতে হয়। চাপ পড়লেই সে কী আওয়াজ! রাস্তায় দৌড়ে দৌড়ে ব্যালেন্সের সেই চাকা চালানোর খেলার কথা মনে পড়ে। বিশ্বকর্মা পুজোর দিন কারখানায় ঢুকতে পারার সুযোগে কারখানা থেকে তন্ন তন্ন করে খুঁজে এনেছি সেই লোহার চাকা– কৈশোরের এক ঐশ্বর্য-সম্পদ। মোটা তার দিয়ে ঠেলে ঠেলে আমরা সেই চাকা রাস্তা ধার দিয়ে চালিয়ে নিয়ে যেতাম, যেন নিজেদের হাতে নিজেদের জীবন চক্র!
আর! আর! আকাশ জুড়ে ঘুড়ির উড়াউড়ি। চৌমুখি, শতরঞ্জ, আধপেট্টি, চাঁদিয়াল কত সব ঘুড়ির নাম!
বিশ্বকর্মা পুজো হবে আর ঘুড়ির লড়াই হবে না সে কি কখনো হয়!
সেইসব দিনের কারখানার বিশ্বকর্মা-পুজো, ঘুড়ি উড়ানোর উৎসব খুবই মনে পড়ে।