ভারতীয় সংসদে প্রথম বাঙালি স্পীকার সোমনাথ চট্টোপাধ্যায়ের জন্মদিবস আজ
অবতক-এর বিশেষ প্রতিবেদন
কাঁচরাপাড়া একদিন সংবর্ধনা জানিয়েছিল তাঁকে
তমাল সাহা
ভারতীয় সংসদীয় রাজনীতির ইতিহাসে অন্যতম ব্যক্তিত্ব এবং বিতর্কিত বহু আলোচিত সাংসদ এবং প্রাক্তন স্পিকার সোমনাথ চট্টোপাধ্যায় প্রয়াত হয়েছিলেন ১৩ আগস্ট, ২০১৮ সকাল ৮টা নাগাদ। বার্ধক্যজনিত কারণে তিনি চিকিৎসারত ছিলেন। মিন্টো পার্ক সংলগ্ন একটি বেসরকারি নার্সিং হোমে তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন।
ভারতীয় সংসদীয় রাজনীতি যতদিন থাকবে ততদিন স্পিকার সোমনাথ চট্টোপাধ্যায় সেই রাজনীতির ইতিহাসে লিপিবদ্ধ থাকবে।
আমরা এ অঞ্চলের মানুষ, কাঁচরাপাড়ার মানুষ গর্বিত এই কারণে যে তিনি কাঁচরাপাড়ার জনজীবনের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। কাঁচরাপাড়ার জনজীবনের সঙ্গে যুক্ত আর একজন মানুষ এবং রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব হলেন জ্যোতি বসু।
ট্রেড ইউনিয়ন আন্দোলনে যার হাতেখড়ি হয়েছিল কাঁচরাপাড়া রেলওয়ে ওয়ার্কশপ থেকে । শ্রী জ্যোতি বসুর অন্তরঙ্গ ছিলেন সোমনাথ চট্টোপাধ্যায়।
প্রখ্যাত আইনজীবী এন সি চ্যাটার্জীর সুযোগ্য পুত্র তিনি। অদ্ভুত বৈপরীত্য ছিল পিতা-পুত্রের রাজনৈতিক জীবনে।পিতা ছিলেন হিন্দু মহাসভার নেতা।তিনি হুগলি লোকসভা কেন্দ্র থেকে প্রার্থী হয়েছিলেন। তাঁর পক্ষে কাঁচরাপাড়া সার্কাস ময়দানে প্রচার সভা করে গিয়েছিলেন ডঃ শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়।বীজপুর বিধানসভা কেন্দ্র তখন হুগলি লোকসভা কেন্দ্রের অন্তর্ভুক্ত ছিল। অথচ পুত্র সোমনাথ চট্টোপাধ্যায় ছিলেন বামপন্থী। সিপিআইএম দলের সদস্য ও সাংসদ।
এই শহরের আর একটি গর্ব, এই শহরের শ্রমিক অধ্যুষিত মেহনতি মানুষের পক্ষ থেকে তাঁকে নাগরিক সংবর্ধনা দেওয়ার আয়োজন করা হয়েছিল। ‘সোপান’ নামে একটি প্রগতিশীল সংগঠন সেই দায়িত্ব গ্রহণ করে। কাঁচরাপাড়া গান্ধী মোড়ে অনুষ্ঠিত জনসমাবেশে তিনি সংবর্ধিত হন। তারিখটি ছিল ১১ই ডিসেম্বর ২০০৫, রবিবার। দুপুর তিনটের সময় তিনি নাগরিকভাবে সংবর্ধিত হয়েছিলেন। সর্বস্তরের রাজনৈতিক নেতারা সেই সভায় উপস্থিত ছিলেন।
ভারতীয় আইনবিদ সোমনাথ চ্যাটার্জী ছিলেন একজন দক্ষ পার্লামেন্টারিয়ান এবং সেই হিসেবে তিনি দক্ষ সাংসদের শিরোপাটি অর্জন করেছিলেন। লোকসভা জীবনের দীর্ঘ অভিজ্ঞতার কারণেই তিনি এই অ্যাওয়ার্ড দ্বারা সম্মানিত হন।
স্পিকারের পদটি বামপন্থীদের হাতে তুলে দেওয়ার জন্য কংগ্রেসের অনুরোধ, আবেদন ভারতবর্ষের রাজনৈতিক ইতিহাসে একটি বিশেষ পর্ব বলে সূচিত হয়ে থাকবে। উল্লেখ্য ব্যক্তিত্ব সোমনাথ চট্টোপাধ্যায়ের এই পদ অর্জন সাম্প্রদায়িক দল বলে চিহ্নিত বিজেপি দ্বারাও সমর্থিত হয়েছিল।
ভারতবর্ষের ৬১তম স্বাধীনতার প্রাক্কালে লোকসভার স্পিকার সোমনাথ চট্টোপাধ্যায় সংসদীয় রাজনীতিতে ইতিহাস সৃষ্টি করেন। তিনি পার্লামেন্টেরও সদস্য ছিলেন।
গণতন্ত্রের ধাপ্পাবাজির শিকার হয়েছিলেন তিনি। তাঁকে সেইসময়ে সিপিএম পার্টি থেকে বহিষ্কার করা হয় ২৩শে জুলাই ২০০৮।
তিনি শাস্তি পেয়েছেন কিনা জানিনা কিন্তু কতগুলি বিতর্কিত প্রশ্ন তিনি তুলে দিয়ে গিয়েছিলেন—
১)স্পিকারের কোনো দল নেই, তিনি দলীয় রাজনীতির উর্ধ্বে, ২)বর্তমান ভারতীয় পরিস্থিতিতে তথা রাজনীতিতে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ থেকে জাতীয় সাম্প্রদায়িকতা বড় শত্রু।
এই প্রসঙ্গে উল্লেখ্য ভারতীয় কমিউনিষ্ট পার্টি মার্কসবাদীতে দক্ষিণাঞ্চলের আধিপত্য প্রবল। তিনি যতই রাজনীতি সংক্রান্ত যুক্তি দেখান,দক্ষিণী আধিপত্য প্রকৃতই চায় না বাঙালি জ্যোতি বসু প্রধানমন্ত্রী হোন বা সোমনাথ চট্টোপাধ্যায় ভারতীয় সংসদের স্পিকার হোন। আপাতভাবে এটি যুক্তির সরলীকরণ মনে হলেও সত্য।
সোমনাথ চট্টোপাধ্যায়কে রাষ্ট্রপতি এবং উপরাষ্ট্রপতি হতেও বাধা দিয়েছিল তার এই পার্টি।
সাংসদ হওয়ার পর সংসদীয় রাজনীতিতে সোমনাথ চট্টোপাধ্যায় পর পর দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছিলেন। ১)লোকসভার স্পিকার হিসেবে তিনি ৯ মার্চ ২০০৫, ঝাড়খণ্ড বিধানসভায় স্পিকারের বিরুদ্ধে আদালতের অভিযোগ সংক্রান্ত একটি বিষয়কে কেন্দ্র করে একটি বিতর্ক উস্কে দিয়েছেন– আইনবিভাগের কাজে বিচারবিভাগ হস্তক্ষেপ করতে পারে কিনা। উল্লেখ্য এটি গণতন্ত্রের স্বার্থে তাঁর সৃষ্টিশীল চিন্তার পরিচয়।
২০শে মার্চ ২০০৫ এই প্রসঙ্গে একটি বৈঠকে ২২টি বিধানসভার স্পিকার যোগদানও করেন। পরবর্তীতে সুপ্রিম কোর্ট এই বিষয়ে তাদের ভুল স্বীকার করতে বাধ্য হয়।
২)সাংসদদের ঘুষ নেওয়ার অভিযোগে সাংসদ সোমনাথ চট্টোপাধ্যায় অভিযুক্ত সাংসদের সদস্যপদ খারিজ করে দিয়ে গণতন্ত্রের পতাকা উজ্জ্বল করেছিলেন,এটি একটি ঐতিহাসিক দৃষ্টান্ত।
৩) ২৫শে নভেম্বর ২০০৫ ‘নারী কাজ ও স্বাস্থ্য’ বিষয়ক আন্তর্জাতিক কংগ্রেস উদ্বোধনে তিনি যখন উচ্চারণ করেন, তিনি স্পিকার থাকাকালীনই সংসদে মহিলাবিল পেশ এবং গৃহীত হোক, তখন নতুন এক মানবিক দৃষ্টি উজ্জ্বল হয়ে ওঠে ভারতীয় গণতন্ত্রে এবং সমাজ জীবনে। উল্লেখ্য ৫৮টি দেশের ৪০০ জন প্রতিনিধি উপস্থিত ছিলেন এই সম্মেলনে।
৪) সংসদীয় ইতিহাসে এক অন্যযুগের সূচনা করেছিলেন তিনি। সাংসদদের ‘সামাজিক অনুশাসন’-এ শিক্ষিত করে তুলতে সংসদে বিশেষ বক্তৃতার উদ্যোগ তাঁরই চিন্তার ফসল।
কাঁচরাপাড়ায় সোমনাথ চট্টোপাধ্যায়কে সংবর্ধনা প্রদান সম্পর্কে ‘সোপান’ উৎসব কমিটির অন্যতম দুই সদস্য অরুণ আগরওয়াল এবং উজ্জ্বল দত্ত জানান, তাঁকে এই শহরে আনা আমাদের জীবনে একটা ইতিহাস হয়ে থাকবে। আমাদের কালঘাম ছুটে গিয়েছিল তাঁকে রাজি করাতে। কত দিনরাত যে পরিশ্রম করতে হয়েছে! সাংসদ অলকেশ দাস খুবই সহযোগিতা করেছিলেন।
এই সব উজ্জ্বল ঘটনা কাঁচরাপাড়ার রাজনৈতিক জীবনে নিশ্চিত ইতিহাস হয়ে থাকবে।