আমি পুজোয় কি কি দেখি?

তালব্য-শ দন্ত্য-স মূর্ধন্য-ষ বর্ণগুলি হাঁটতে থাকে
তমাল সাহা

শেষ পর্যন্ত বাংলা বর্ণমালা হাতের মুঠোয় করে আমি অগ্নিময় হয়ে উঠবো। তোমাদের ভালোবাসা পাইনি বলে দুঃখ নেই কোনো। বর্ণমালাকে ভালোবেসে আমি চলে যাবো।

আশ্চর্য! এই সার্বিক মাঙ্গলিক ঋতুতে তালব্য-শ, দন্ত্য-স এবং মূর্ধন্য-ষ বর্ণ তিনটি সূর্যের হিরন্ময় রশ্মির প্রতিফলন ঘটিয়ে বিস্তীর্ণ হতে থাকে….

আমি শারদ উৎসব- শব্দ দুটির মধ্যে তালব্য-শ এবং দন্ত্য-স’র প্রাধান্য দেখলেও উৎসব শব্দটিতে সবার উত্থানের চেতনাময় ব্যঞ্জনার সন্ধান পাই‌

শরৎ ঋতু সাহিত্য সংস্কৃতি শিল্পে প্রাণময় হয়ে ওঠে। বিশাল বিশাল আকাশস্পর্শী প্যান্ডেল ষণ্ডা মার্কা হলেও শ্রমের আধারে তা সৃজন করে শ্রমজীবীশ্রেণি। এতো অস্বীকার করার উপায় নেই এই পাষণ্ড নেতাদের অনুশাসন-শাসনের সমারোহে সৃষ্টি হয় এক একটি প্যান্ডেল। যদিও সহস্র মুদ্রার অবৈধ কারবার এবং কামাই যুগপৎ চলে সরকারি সহায়তায়।

আমি শারদ উৎসবে সপ্তমীর দিন পুস্তক বিপণি সাধারণ ভাষায় বইয়ের স্টলে গিয়ে বসি। মার্কসীয়-অমার্কসীয় সারি সারি সাজানো বইগুলি স্পর্শ করে দেখি, পৃষ্ঠা উল্টে পাল্টে পড়তেও থাকি।
বেলা পড়ে গেলে সান্নিধ্য সৌহার্দ্য শব্দদুটির বিস্তৃতি ঘটে বলে আমার মনে হয়। আগে যে শত্রু ছিল এখন তাকে সহযোগী বলে বোধ হয়। কেননা শেষ পর্যন্ত তো ভালোবাসাই জিতে যায়।
স্টলে গিয়ে দেখি সত্তর দশকের পরিচিত সহযোদ্ধা অসীম গিরি বসে আছে। যখন তখন যেখানে সেখানে সরব উচ্চারণে গান গাইবার ওস্তাদি আছে আমার বন্ধুর কন্ঠে। বন্ধুটি আমার সিঙ্গুর নন্দীগ্রাম লালগড় সেসব তো আছেই, তারো আরো আগে সংগ্রামী মঞ্চে কত সংগীত গণসংগীত ছুড়ে দিয়েছে বাতাসে বাতাসে…

অষ্টমী চলে আসে। ঢাক ও কাসির সশব্দ যৌথ সঙ্গতে সন্ধিপুজো দেখি। এদিন সব মেয়ের মুখগুলি আমার সুশ্রী শুদ্ধ সৌন্দর্যময় মনে হয়। নমস্তস্যৈ শব্দটি শৌর্য নিয়ে শ্রাব্যসুখ নিশ্চিত আনে।
তারপর আমি হাঁটতে থাকি। সাহসী সব তরুণ তরুণীর দুঃসাহসিক চলাফেরা দেখি। পাশাপাশি হেঁটে উচ্ছ্বিসত শব্দে কী যেন বলে তারা! সমবেত শাড়িরা সৌকর্য নিয়ে হেঁটে চলে। কেউ হয়ে ওঠে ঋদ্ধিমা, কেউ হয়ে ওঠে ঋতমা, ঋকতা,ঋষিমতী বা ঋক্ষমা।জন কোষাগার থেকে শত সহস্র মুদ্রার ব্যয়ে শিল্পিত ভাবনার প্যান্ডেল দেখি। দেখি কোথাও কোথাও সাংস্কৃতিকআয়োজন– চিত্র-আলোকচিত্র প্রদর্শনী।

নবমী নিশি চলে আসে। শেষ প্রহরে বিষাদের অবয়ব নিয়ে প্রতিমা দাঁড়িয়ে থাকে ঠাকুর দালানে। রাস্তায় চলমান জনতার সমাগম। একে বলে চলমান ভিড়।
মুচি কাকে বলে? বিপদ মোচন করে যে সে কি মুচি হতে পারে? সেলাই ও সুচে বুননের দ্রুত হস্ত চলাচল দেখি।
কবিগুরু রবীন্দ্র পথে রাস্তার পাশে একটি গাছ ঝাপড়ানো মাথা নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। খুব উঁচু নয়। দুটি মুচি বসে আছে। কর্মরত। পাশে একটি প্যান্ডেলে এলইডি রোশনাই ছড়িয়ে পড়েছে তাদের চারদিক খোলামেলা জুতো মেরামতির দোকানে।
দেখি মেয়েরা লাইন দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। এত তরুণী কেন? এরা কোত্থেকে আসে?
আমি সকৌতূহলে অনুসন্ধানে মেতে উঠি। চর্মকার-চামারের এত মূল্য আগে বুঝিনি কখনো। এতো শারদা! এতো সজ্জা! আমি তাকিয়ে থাকি এইসব পরিশ্রান্ত মাতৃ প্রতিমার মুখসৌন্দর্যের দিকে। মাকে দেখতে এদের এতো শ্রম ও স্বেদকে সম্মান ও শ্রদ্ধা জানাই। রম্যাণি মেয়েরা আমার! হাঁটতে হাঁটতে কারুর জুতোর সোল খুলে গেছে, কারো স্লিপারের স্ট্র্যাপ ছিড়ে গেছে। মুচিরা দ্রুত সেলাই করে দিচ্ছে। পেরেক ঠুকে সারাই করে দিচ্ছে।
‘আমারটা একটু আগে সেলাই করে দাও না গো!’ নবমী নিশি যে শেষ হয়ে যায়।

মেয়েদের চটি ছিড়ে যাবার কথা মুচিরা কি করে আগেভাগে জানে? তারা জ্যোতিষী নাকি! শেষ পর্যন্ত সমস্যার সমাধান হয়ে যায় তরুণীরা আবার হাঁটতে থাকে।

আমি মেয়েদের বলি, শোনো! দুর্গার পায়ে জুতো দেখেছো কখনো? কৈলাস থেকে উমা এইজন্য খালি পায়ে আসে। পাহাড়-পর্বত ডিঙিয়ে খানাখন্দর পেরিয়ে বাপের বাড়ি আসতে চটি ছিড়ে যেতে পারে‌। তাই সে আলতা রাঙা খালি পায়ে হেঁটে হেঁটে আসে। পথে কোথায় চর্মকার পাওয়া যাবে কে জানে?

শয়তান ধর্ষক পথে পড়তে পারে তা সে জানে। তাই সে নিজে দশাস্ত্র হাতে এবং যোদ্ধা কার্তিককে সায়ক হাতে নিয়ে আসে!