অন্য দুর্গা– ছৎ
দুর্গার দুগ্গিগিরিঃ দুর্গি যখন বারাঙ্গনা, চলতি ভাষায় বেশ্যা
তমাল সাহা
অসুর শব্দটি বহুশ্রুত। অসুর শব্দটির মধ্যে ছোটবেলা থেকেই আমাদের মধ্যে একটি ঘৃণার জাগরণ ঘটিয়ে দেওয়া হয়েছে। অন্যদিকে এমন কথাও আমরা বলি,
অসুরকে আমরা ঘৃণা করি
অসুররা নিপাত যাক
প্রজন্ম আমার আসুরিক শক্তির শক্তি পাক।
এই তো চরিত্র আমাদের তথাকথিত শিক্ষিত সমাজের!
ক’টি অসুরের নাম করো– বললেই প্রথমে আমরা বলি মহিষাসুর, তারকাসুর, বকাসুর। রাবণকেও অসুরের মধ্যে ফেলা হয় যদিও তাকে বলা হয় রাক্ষসরাজ– দশানন। মহাকবি মাইকেল মধুসূদন তাকে বীরশ্রেষ্ঠ বলে অভিহিত করেছেন এবং পুরোপুরি রামায়ণ রচয়িতা বাল্মীকির বিরুদ্ধাচারণ করেছেন।
যাইহোক শরতের নীল আকাশের সারা শরীরে জুড়ে ঝকঝকে রোদ, শরতের সৌন্দর্যে মাটিতে সুখের দোলা কাশবনে, শিউলি তলায় শিউলিরা শিশিরাক্ত আবহে ঝরে পড়েছে, সরোবরের কাকচক্ষু জলের সবুজ পাতার ভেতর ফুটে আছে পদ্মকলির বিস্তৃত অনুভূতি।
শরতের বাতাবরণে আগমনীর ব্যঞ্জনা।
কিন্তু, একটা কিন্তু আছে।এখন এই উৎসব স্মৃতির জানালা খুলে তাদের কাছে হয়ে উঠেছে শোক পালনের উৎসব। ভারতবর্ষের প্রকৃত মালিকানা যাদের,তারা অনার্য জাতির মানুষ। এই মানুষ-অধিবাসীরা রয়েছেন যাদের একশ্রেণী নিজেদের মহিষাসুরের বংশধর বলে মনে করেন তো বটেই গর্ব ও অহংকার করেন। তাদের কাছে দেবীদুর্গা ছলনাময়ী এবং ধ্বংসের দেবী। দুর্গা তাদের কাছে মৃত্যুদূতী।
সরকারি জনগণনা অনুযায়ী পশ্চিমবঙ্গে এখনো রয়েছে অসুর সম্প্রদায়ের মানুষ ৪৮৬৪ জন।এরা ভারতবর্ষের বিভিন্ন রাজ্যে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছেন। ঝাড়খন্ড সংলগ্ন পুরুলিয়া, পশ্চিম মেদিনীপুর, বাঁকুড়া, উত্তরবঙ্গের আলিপুর, জলপাইগুড়ির চা বাগান অঞ্চলে এদের বসবাস। আলিপুরদুয়ারের একটি গ্রামের নাম অসুরপাড়া।
এই জনজাতির গর্ব এদের রাজা হুদুর দুর্গা। আর তাদের বিশ্বাস এই দুর্গা থেকেই তথাকথিত দেবী দুর্গা নামের উৎপত্তি। প্রকৃতপক্ষে হুদুর দুর্গা যাকে আমরা বলি তার প্রতিরূপ মহিষাসুর। সাঁওতাল লোকসাহিত্য অনুযায়ী তাদের এই নেতার কণ্ঠস্বর ছিল বজ্রের মতো আর হুদুর শব্দের অর্থ ঝড়। তার ছিল ঝোড়ো গতিবেগ।
কথিত আছে আর্য সেনাপতি দেবরাজ ইন্দ্র সাতবার যুদ্ধ করেন অনার্য নেতা হুদুর দুর্গার সঙ্গে এবং পরাজিত হন। শেষ পর্যন্ত দেবরাজ ইন্দ্র,তিনি নাকি সুসভ্য আর্য সেনাপতি! ছলনার আশ্রয় নিতে বাধ্য হন। দেবী দুর্গার শরণাপন্ন হন। দেবী বারাঙ্গনা যাকে আমরা চলতি কথায় বলি বেশ্যা সেই রূপে আবির্ভূত হন হুজুরের সামনে। হুদুর দুর্গা প্রথম দর্শনেই তাকে প্রত্যাখ্যান করেন কিন্তু শেষ পর্যন্ত নারীর ছলনায় মুগ্ধ হয়ে তার সঙ্গে পরিণয় সূত্রে আবদ্ধ হন। পরবর্তীতে বিবাহের নবম দিনে সশস্ত্র রূপ ধারণ করে দেবী দুর্গা নিরস্ত্র স্বামী হুদুরকে হত্যা করেন।
এই অলৌকিক বিশ্বাস থেকেই দুর্গোৎসবের চারদিনব্যাপী শোকদিবস পালন করেন এই অসুর সম্প্রদায়। এই উৎসব দাসাই উৎসব নামে পরিচিত। পুরুষরা নারীর সাজে মাথায় ময়ূরপুচ্ছ দিয়ে নিজেকে সজ্জিত করেন। তারপর ভুয়াং-উদ্দাম নৃত্য করে বুক চাপড়ান হতাশায় আর হায়! হায়! উচ্চারণে বাতাস মাতিয়ে দেয়।
তাদের প্রচলিত সংস্কার এমনই যে এই দুর্গোৎসব বা শারদোৎসবের চারদিন তারা বাড়ির গণ্ডির বাইরে যান না। তাদের সংস্কার দুর্গার প্রকোপে তারা ধ্বংস হয়ে যেতে পারেন। এই কদিনের জন্য তারা চাল ভাল প্রয়োজনীয় নিত্য সামগ্রী ঘরে মজুত রাখেন।
এই অসুর সম্প্রদায় এখন ভারতবর্ষের বিভিন্ন অঞ্চলে শ্রমনির্ভর জীবন-যাপন করছেন। চা বাগানে খাদানে তারা কুলি কামিন হয়ে শ্রমিষ্ঠ জীবন যাপন করছেন।