অবতক খবর, সংবাদদাতা, পশ্চিম মেদিনীপুর ::- পশ্চিম  মেদিনীপুরের কেশিয়াড়ি ব্লকের আদিবাসী ও শবর সম্প্রদায়ের মানুষের বসবাসকারী লালমাটির গ্রাম রাংটিয়া ।এই গ্রামে মোট 110 টি আদিবাসী সবর সম্প্রদায়ের মানুষেরা বসবাস করেন ।

দিনমজুরি করে, শালপাতা কুড়িয়ে,মূলত আদিবাসীদের খাবারের জন্য গাছের মূল বেঁচে তাদের সংসার চলে।তবে অভাব অনটনের মধ্যেও তাদের পুরনো ঐতিহ্যের প্রতীক মনোগ্রাহী আদিবাসী নৃত্য, বিশেষ করে আদিবাসীদের “কাঠি নৃত্য” শৈলীকে এখনো ভুলে যায়নি তারা ।

রুজির টানে- জীবন ধারণের লক্ষ্যে নয় ,সংগ্রামী জীবনে নিজেদের প্রাচীন ঐতিহ্যকে বাঁচিয়ে রাখার চেষ্টায় এখনো “কাঠি নৃত্য” চালিয়ে রেখেছে তারা ।দৃষ্টিনন্দন মনোগ্রাহী এই নৃত্য হারাতে বসেছে এখন অর্থের অভাবে ।এই নৃত্যের জন্য প্রয়োজনীয় সরঞ্জাম কেনার মতন সামর্থ্য নেই রাংটিয়া গ্রামের এই সকল আদিবাসী সবর সম্প্রদায়ের মানুষের ।

এই শবর সম্প্রদায়ের প্রায় তিন পুরুষ এর আগে থেকে শুরু হয়েছে এই “কাঠি নৃত্য”।মধ্যিখানে প্রায় 10 থেকে 12 বছর অর্থ, প্রয়োজনীয় সরঞ্জামের অভাব ও দক্ষ শিল্পীদের হারিয়ে বন্ধ হয়ে গিয়েছিল বলে জানান উক্ত সম্প্রদায়ের মানুষরা ।তবে নিজেদের প্রাচীন ঐতিহ্যকে বাঁচিয়ে রাখার চেষ্টায় পুনরায় তারা শুরু করেছেন এই “কাঠি নৃত্য “।

এই সকল মানুষের রুজি রোজগার বলতে তেমন কিছুই নেই । দিন আন্তে দিন যায় এমনই অবস্থা এই রাংটিয়া গ্রামের 110 জন আদিবাসী শবর সম্প্রদায়ের ।তাই এই নৃত্যের জন্য প্রয়োজনীয় সরঞ্জাম কেনার মতন সামর্থ্য নেই তাদের ।

নিত্য সরঞ্জাম হিসাবে ব্যবহৃত হয় নৃত্য শিল্পীদের পায়ে থাকে ঘুঘুর ,আর প্রত্যেকের পরনে একই রঙের এক ধরনের শাড়ি ,এছাড়াও মাদল ঝুমকো ও অন্যান্য সামগ্রী । কিন্তু অর্থাভাবে শুধুমাত্র একটি মাদল দিয়েই এখন এই নৃত্য কে চালিয়ে রাখা হয়েছে বলে জানান এই নৃত্যের কারিগর তথা গায়ক দুলাল প্রামানিক ।

এছাড়াও এই “কাঠি নৃত্য” বাদে বাকি আরো অনেক নৃত্য রয়েছে ।সেগুলির ক্ষেত্রেও ঠিক একই ব্যাপার ।যেমন চাং নৃত্যের ক্ষেত্রে ব্যবহৃত “চাং” ।তাও নেই ।যেটি ছিল তা ফেটে গিয়ে নষ্ট হয়ে গিয়েছে ।তাই সংকটের মধ্যে বর্তমান কেশিয়াড়ী ব্লকের রাংটিয়া গ্রামের আদিবাসী শবর সম্প্রদায়ের নৃত্য শৈলী ।

নজর নেই প্রশাসনের অভিযোগ এলাকাবাসীর ।শিক্ষার আলো তেমন একটা পৌঁছায়নি উক্ত গ্রামে ।তাই শিল্পী ভাতার জন্য প্রয়োজনীয় দরখাস্ত করতে পারেননি তারা ।শিল্পী ভাতা তো দূর অস্ত বার্ধক্য ভাতা টুকুই পাননি অধিকাংশ এলাকাবাসী ।অর্থাভাবে নিজেদের ঐতিহ্যের স্মারক আদিবাসী নৃত্য শুধু হারিয়ে যেতে বসেছে তা নয় সেই সঙ্গে নিজেদের দুরারোগ্য রোগে আক্রান্ত হয়েও সারাতে পারছেন না তারা ।

তেমনি উক্ত নৃত্য শিল্পের সঙ্গে যুক্ত এক শিশু শিল্পীর মুখমন্ডলের ভেতরে গলার কাছে রয়েছে একটি টিউমার ।জন্ম থেকেই সেটি ছিল বলে জানিয়েছেন পরিবারের লোকেরা ।অর্থাভাবে কাছের কয়েকটি হাতুড়ে চিকিৎসকের কাছে ওষুধ খেয়ে কোন রকমই   রয়েছে ।বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে তা ক্রমশ বড় হচ্ছে ও মুখমণ্ডল ও গলার কাছে তা বেড়ে যাচ্ছে ।

কোথায় গেলে সঠিক চিকিৎসা হবে এবং অর্থের অপচয় হবে না তাও জানেন না তারা ।অপর এক শিল্পী যার জন্ম থেকে ডান হাত ও পায়ের কোন আঙুল নেই ।পঙ্গু অবস্থায় রয়েছে ।তবে পঙ্গু হাতেও নিখুঁত মাদল বাজাতে তিনি অভ্যস্ত । শরীর সাথ না দিলেও এই নৃত্যের সঙ্গে তিনিও মাঝেমধ্যে অংশগ্রহণ করেন ।

বর্তমান এই কাঠি নৃত্যের জন্য মোট 20 থেকে 25 জন শিল্পী রয়েছেন ।তবে প্রত্যেকেরই একই বক্তব্য সরকারি ভাবে সহযোগিতা না পেলে একদিন হয়তো আমাদের এই নৃত্য বন্ধ করে দিতে হবে ।আমাদের ঐতিহ্য বহনকারী এই নৃত্য গুলি আর থাকবে না ।

নিজেদের বেঁচে থাকার জন্য খাবার জোগাড় করবো না এই নৃত্য করব বলে জানালেন এলাকায় অবস্থিত বর্তমানে একমাত্র উচ্চশিক্ষিত ব্যক্তি হাবু প্রামানিক ।নিজেও সরকারিভাবে তেমন কিছু পাননি বর্তমান এলাকাবাসীরা যাতে শিক্ষিত হয় ।

আগামী দিনে এলাকায় শিক্ষার আলো ছড়িয়ে পড়ে তার জন্য নামমাত্র অর্থের বিনিময়ে তিনি এলাকাবাসী ছোট ছোট ছেলেমেয়েদের টিউশন পড়ান। এছাড়াও তিনি জানান -“আমাদের এই গ্রামে প্রত্যেকটি মানুষ দিনমজুর ,কেউবা শালপাতা কুড়িয়ে থালা বাটি তৈরি করে বাজারে বেচেন খুবই সামান্য নামমাত্র মজুরি পান ।

অনেকে গাছের মূল তুলে সেগুলো বিক্রি করেন তার উপরে সংসার চলে ।আমাদের এই নৃত্য গুলি করে পেট চলে না, দুর্গাপূজার সময় বা তারপরে আমরা কাছের গ্রামগুলিতে বাড়ি বাড়ি গিয়ে নৃত্য প্রদর্শন করি যে যেমন পারে পাঁচ থেকে দশ টাকা কেউ বা চাল দিয়ে সাহায্য করেন ।এইভাবে মেগে যেচে আমাদের সংসার চলে ।

তবে প্রাচীন ঐতিহ্যকে বাঁচিয়ে রাখার লক্ষ্যে আমরা তা এখনও চালিয়ে রেখেছি ।প্রয়োজনীয় সরঞ্জামের অভাব ।সরকারি সাহায্য টুকুও পাইনি । কেউ শিল্পী ভাতা ও পর্যন্ত পাননি ।কিভাবে বাঁচিয়ে রাখবো আমাদের এই ঐতিহ্যকে ।আগামী দিনে সরকারি সাহায্য না পেলে আমাদের এই নৃত্য গুলো বন্ধ করে দিতে হবে ।”

অর্থের অভাবে বন্ধ হতে যাওয়া ঐতিহ্যের নৃত্য কে বাঁচিয়ে রাখতে সরকারি সাহায্যের দিকে তাকিয়ে কেশিয়াড়ী ব্লকের রাংটিয়া গ্রামের আদিবাসী শবর সম্প্রদায়ের    মানুষেরা ।

এই সম্পর্কে কেশিয়াড়ির বি.ডি.ও সৌগত রায় এর কাছে জানতে চাওয়া হলে তিনি জানান-“এই ধরনের কোন বিষয়ে তার নজরে নেই ।ভাতার জন্য যে কোটা ছিল তা সম্পূর্ণ হয়ে গেছে ।এরপরেও যদি কেউ বাকি থাকে তাহলে তাকে লিখিত জানালে তিনি জেলাতে পাঠিয়ে দেবেন ।

জেলা এর পরে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেবে ।এছাড়াও শিল্পী ভাতা 2016 সাল থেকে দেওয়া বন্ধ । এই মুহূর্তে আর কেউ শিল্পী ভাতা পাচ্ছেন না ।তবে রাংটিয়া গ্রামের যে সমস্যাগুলি রয়েছে তা এলাকাবাসীরা লিখিতভাবে তাকে জানালে তিনি তার প্রয়োজনীয় দপ্তরে পাঠিয়ে দেবেন এবং ব্যবস্থা নেবেন ।”