কিংবদন্তির কি কখনো মৃত্যু হয়? নস্টালজিয়া কি শেষ হয়? তাও যদি হয় ফুটবল রাজপুত্রের, তা আবার শেষ হয় নাকি, যার পায়ের একটা কিকে একসময় উত্তেজনায় ভেঙে পড়তো স্টেডিয়াম, তিনি চিরকালই ছিলেন বর্ণময় তাই তো তিনি বিশ্বসেরা। কোনোদিন কোনো মায়ায় শেষ হবার নয় দিয়াগো আর্মান্দো ম্যারাডোনার গল্প।1960 সালের 30শে অক্টবর আর্জেন্টিনার বুয়েন্স আয়ার্স প্রদেশে ম্যারাডোনার জন্ম, মাত্র পাঁচ ফুট পাঁচ ইঞ্চি উচ্চতার সাধারণ ঘর থেকে উঠে আসা ছেলেটা বিশ্বের দরবারে নতুন ভাবে পরিচয় করলো আরেক ফুটবলের দেশ আর্জেন্টিনাকে। চেনালো ফুটবলের প্রতি নিজের ভালোবাসাকে,ম্যারাডোনা না থাকলে হয়তো কেউ জানতেই পারতো না যে আর্জেন্টিনা নামক দেশটার সাথে এতো সমর্থক থাকতে পারে। ফুটবল তাঁকে অসাধারণ করেছে কি তিনি ফুটবল করেছেন সেটিও ছিল চিরকালীন আলোচনার বিষয়। ফুটবল ইতিহাসের পাতায় অক্ষরে অক্ষরে সাজানো আর্মান্দো ম্যারাডোনা নামটা।

বলবয় থেকে শুরু করে কোটি কোটি ফুটবল প্রেমীদের একেবারে বিশ্বকাপ জেতার স্বপ্নটা দেখিয়েছিলেন তিনি, 1977 এ জাতীয় স্তরে খেলার সুযোগ আসে ম্যারাডোনার, আশির দশকে ফিফা অনুর্ধ 20 তে সোভিয়েত ইউনিয়ন কে পরাজিত করে আর্জেন্টিনাকে বিশ্বকাপ উপহার দেন দিয়াগো। যুব বিশ্ব কাপের সেরা খেলোয়াড় এবং দ্বিতীয় সর্বোচ্চ গলদাতা হিসাবে নির্বাচিত হন ম্যারাডোনা। 1989 র সেরা আর্জেন্টাইন খেলোয়াড় এর সম্মানেও স্বীকৃতি পান তিনি, মিডফিল্ডে খেলেও আর্জেন্টিনার হয়ে পাঁচবার টপ স্কোরার হন। 1982 র আর্জেন্টিনার 14 টি গোলের 10 টি তে জয়ী ছিলেন তিনি। সত্যি, প্রতিভার পাহাড়ে ঢাকা পড়ে যায় জীবনের বাকি বিতর্কগুলো। অবশেষে সালটা 1986 জার্মানি কে পিছনে ফেলে দিয়ে সোনালী বিশ্বকাপ ঘরে আনেন ম্যারাডোনা ঐ বছরই ফিফা থেকে সর্বকালের সেরা খেলোয়াড় নির্বাচিত হন তিনি।

ফুটবলের আবেদন পৃথিবীর কোনায় কোনায়, যাকে ঘিরে লক্ষ কোটি দর্শক শ্রোতার ভালোবাসা অপরিসীম। শত গান, লেখা তৈরী হয়েছে দুধর্ষ এই খেলাকে ঘিরে আর বিশ্বের সেরা একাদশ তালিকায় যাঁদের নাম তাঁদের প্রতি ফুটবল প্রেমীদের আকর্ষণ থাকবে এটাই তো
স্বাভাবিক। তাই ডোপ টেস্টের বিতর্ক বা দলবদলের সিদ্ধান্ত কোনোদিনই ম্যারাডোনার জনপ্রিয়তাকে ফিকে করতে পারেনি। যদিও 1986 পর গোটাবিশ্ব পরপর অনেকগুলো চ্যাম্পিয়ন দল দেখেছে তবুও ম্যারাডোনা ছিলেন বিশ্বের চ্যাম্পিয়ন দের চ্যাম্পিয়ন। তাঁর সমতুল্য কেউ নেই তাহলে কারণটা? আসলে ফ্রান্সের বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন আর মিশর কে নিয়ে মোহাম্মদ সালাহর বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন হওয়া, দুটির গুরুত্বতো তো আর এক নয়, ম্যারাডোনা ক্ষেত্রেও অনেকটা সেইরকম যিনি নিজের খেলার সৌন্দর্য দিয়ে হারিয়ে দিয়েছিলেন সকলকে অনেকটা অসম্ভব কে সম্ভব করেছেন বারে বারে তাই দর্শকের কাছে তাঁর সমতুল্য কেউ আসতে পারেননি আজ অবধি। 1997 এ অবসরে গেলেও মাঠকে ছাড়তে পারেননি। এমনকি ছুটে এসেছিলেন কলকাতার মাটিতে। তিনি বিস্মিত হয়েছিলেন নিজের জনপ্রিয়তা দেখে, এতো ভালোবাসা পেয়ে তিনি এক সাক্ষাৎকরে বলেছিলেন, সারাজীবনে ‘নাপোলির’ মতো সম্মান পেলেন। নিজেকে ‘চে’ এর ভাবাদর্শে অনুপ্রাণিত করতেন আজীবন। হঠাৎই হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে চলে গেলেন রাজপুত্র। ম্যারাডোনার মৃত্যুতে মন ভারাক্রান্ত তাঁর অগুনতি ভক্তদের,শোকস্তব্ধ এখন বিশ্ব ফুটবল দুনিয়া। খবরটা নাড়িয়ে দিয়ে গেল একাধিক বিশ্বের ক্রীড়া জগৎ কে, পেলে থেকে মেসি, ক্রিস্টিয়ানো রোলান্ড , রুনি, জিদান আজ সকলেই স্তব্ধ এই খবরে। সবাই ভাবছেন ফুটবলের দিয়েগোর কথা। ফুটবল জীবন্ত থাকবে চিরকালই। আর ম্যারাডোনা, যিনি আজীবন জীবন্ত থাকবেন পাঁচ ছয় জন ডিফেন্ডারকে ছিটকে ফেলে কোনো গোলের মাঝে, দশ নম্বর জার্সি জ্বলজ্বল করে ছুটবে শত কোটি দর্শকের উচ্ছাসে। মাইলস্টোন হয়ে হয়ে বিরাজ করবেন আগামী ফুটবলপ্রেমীদের কাছে তিনিই দিয়াগো আর্মান্দো ম্যারাডোনা, ফুটবলের শেষ কথা।
সুমনা আদক —-