প্রতিবছর আসে ভাইফোঁটা। সত্যিই কি যমের দুয়ারে পড়ে কাঁটা? ভাই-বোন পৃথিবীর আশ্চর্য উপহার। শুনুন একটি কাহিনী তাহার।

ভাইফোঁটা
তমাল সাহা

দীপাবলির রাত চলে যায়…
বিষণ্ণ বাতাসে শীতের আভাস এসে পড়ে।
হেমন্তের হাওয়ায় ঝরে যায় দু একটি পাতা।
জানালায় দাঁড়িয়ে বোনটি উল্টে যায়
অতীত স্মৃতির খাতা।

প্রতিপদে অগ্নিকোণে
উঠে আসে পূর্ণ যুবতী চাঁদ।
শিশিরের মতো টলটলে জল জমে
চোখের প্রান্তিকে।
আজই তো সেইদিন যেদিন ওরা পেতেছিল
দাদার মরণ ফাঁদ।

রাতের গভীরে চোখের পার ভেঙে যায়
ছুটে আসে অশ্রু ঢেউ,
চাপা দুঃখে কন্ঠস্বর আছড়ে পড়ে—
কাল ভ্রাতৃদ্বিতীয়া।
মনে পড়ে দাদা বলেছিল,
আমার নাম হৃদয়। তাহলে
বোনটি আমার,তোর নামটি রাখি হিয়া।

কত কথা মনে পড়ে আজ, হিয়ার
আকাশের দিকে তাকায়
দেখে বিন্দু বিন্দু নক্ষত্রের বাহার!
দাদা কি হয়ে গিয়েছে
কালপুরুষের কোনও নক্ষত্র,
হাতে রয়েছে তার
তিরধনুকের মতো কোনো অস্ত্র!
দাদা এখনো ঘুরে বেড়ায় আগের মতো,
সৌরজগতেও যত্র তত্র?

দরাজ গলা ছিল দাদার।
বর্ষাভেজা রাতে অথবা নদীর ধারে
কখনো অরণ্য গভীরে শুনশান—
কী অপূর্ব কন্ঠ তাহার!উঠতো গেয়ে
রবীন্দ্রনাথ-গণ সঙ্গীত অথবা লোকগান।

কবে কি হল জানিনা,
মনে পড়ে না তেমন আর…
শুধু সুর তালে কি হবে,বোঝালো আমাকে। কন্ঠে চাই গানের সাথে স্লোগান,
হাতে দুরন্ত মেশিন গান।
এ কোন রাজনীতি,
যাতে প্রয়োজন পৃথিবীর যাবতীয় গান!
দাদা বলেছিল,
এতেই লুকিয়ে আছে মানব পরিত্রাণ।
অন্য কিছু নয় তো, মানুষের জয়গান।

বাড়ি ছেড়ে চলে যায় দাদা,
বনানী-পার্বত‍্য পরিবেশ হয়ে ওঠে তার আবাস।
মিশে যায় প্রকৃতির সুবাসে, তাদের সাথে
যাদের জীবনের একমাত্র পুঁজি
কেন্দুপাতা-বাবুই ঘাস।

লাল পতাকা ওড়াতো দাদা।
আরণ্যক জীবন লিখতো চিঠিতে।
সে বড় উজ্জ্বল সবুজ কালি,
সাজাতো বর্ণমালা, মুক্তোর মতো হরফ,
উঠে আসতো স্বদেশের ছবি—
কত সে সব গাছপালা,
বর্ণিল সব ছোট-বড় পাখপাখালি।

দাদা বলেছিল, এবার আসবে গোপনে।
হয়েছে কমান্ডার,
কাঁধে তার মস্ত এক রাইফেল,
কোমরে লুকিয়ে অথচ মাথাউঁচু পিস্তল
নেবে আমার হাতে ভাইফোঁটা।
লিখেছিল চিঠিতে,হিয়া! নিশ্চিত এবার
তোর দাদার যমের দুয়ারে পড়বে কাঁটা।

প্রতিপদে রওনা দিয়েছিল সে গোপনে।
সেদিন আকাশে উঠেছিল আততায়ী চাঁদ
ঘাসের উপরে পড়েছিল তার ছায়া।
গ্রিনহান্টের সশব্দ গর্জনে
রাতের স্তব্ধতা ভেঙে খানখান।
ছিটকে মাটিতে উপুড় হয়ে পড়ে
দাদার শক্তিমান দেহ ডানপিটে কায়া।
বিপ্লবী ছিল তো একা,তাকে
খতমে গ্রিনহান্ট!এতো বিশাল আয়োজন!
দাদাকে ছিল রাষ্ট্রের এতো জরুরি প্রয়োজন?

হেমন্ত আসিবে ফিরে
ঝরিবে রাতে হিমেল শিশির।
দাদা! দাদা!
বলে শূন্য হাহাকার ভাসিবে বাতাসে
ভাইফোঁটা আসিবে ফিরে
কেঁদে যাবে স্মৃতি,
ফিরিবে না দাদার সোমত্ত শরীর।

কাহিনীর কি এখানেই শেষ!
আরো কিছু থেকে যায় বাকি।
ইতিহাস তো চলমান…
জীবনকে কি দিতে পারে ফাঁকি?

দাদা ফেরেনা,তবুও ভাইফোঁটা আসে।
সেদিন খুব ভোরে উঠে পড়ে হিয়া।
স্নানঘরে যায়, শুদ্ধস্নানে পবিত্র হয়ে ফেরে।
ভেসে ওঠে কবেকার পুরাতন স্মৃতি…
এখন ঢুকিসনে দাদা! আমি আছি ঘরে।
দাদার সেই কিনে দেওয়া
সাদার উপর চুমকি বসানো শাড়িটি
সুন্দর করে পরে—
আয়নার সামনে দাঁড়ায়।
তারপর দাদার ছবি কোলে নিয়ে
লাল চন্দনে সাজায়।
বাম হাতের কনিষ্ঠাতে ফোঁটায় আলপিন,
বোন পবিত্র রক্তে ভাইফোঁটা দেয়—
দাদার কপাল হয়ে ওঠে রঙিন।

ছবির সামনে মুখ রেখে বলে,
দাদা!শোন, এখনো চলছে লড়াই
আসবেই আসবে সেই একদিন…
তোর লাল পতাকা তুলে রেখেছি আমি
ওড়াবো সেদিন
তীব্রবেগে দুলিয়ে দুলিয়ে…

পূর্ব থেকে পশ্চিম,উত্তর থেকে দক্ষিণ।