অবতক-এর বিশেষ প্রতিবেদনঃ ভূমিপুত্র সুপরিচিত খ্যাতিমান সাহিত্যিক সুব্রত মুখোপাধ্যায়-এর দাহপর্ব সম্পন্ন হলো হালিশহর মহাশ্মশানে ১৭ মার্চ

আমি অশৌচ নিয়ে বসে আছি, সুব্রত চলে গেছে

অবতক,১৮ মার্চঃ আজ আমার অশৌচ। আমার বন্ধু, ক্লাসমেট, লেখার জগতের সঙ্গী সুব্রত চলে গিয়েছে। ‌ স্মৃতিধূসর বারান্দায় এখন বসে আছি। ভাবছি কবে, কোথায়, কি কি হয়েছিল তার সঙ্গে আমার।

বড় মাপের মানুষ ছিল সে লেখার জগতে। ‌ওর আর আমার একই বছরে জন্ম। সেটি ১৯৫০। ওর থেকে আমি দুমাসের বড়। ওর জন্ম জুনে। আমার জন্ম এপ্রিলে। কাঁচরাপাড়া সতীশ নন্দী রোডে ঢুকলে ডানদিকে প্রথম বাড়িতে ছিলুম আমি। আর দ্বিতীয় ভাড়া বাড়িটি পাঁচুগোপাল দে-র বাড়িতে জন্মেছিল সে। ওই যে বলে না,ন্যাংটো পোঁদের বন্ধু। সেই আর কি!

ওর দাদু ধীরাজ মুখোপাধ্যায়ের তখন খুব নামডাক। তিনি পৌরসভার কমিশনারও হয়েছিলেন। তিনি হার্ণেট হাই স্কুলের প্রধান শিক্ষক ছিলেন। পরে ওরা স্কুলের রেল-কোয়ার্টারে চলে যায়। ওদের আদি বাড়ি হালিশহরের চৌধুরীপাড়ায়। ওর বাবা সত্যনারায়ণ মুখোপাধ্যায় ছিলেন ফুটবল খেলোয়াড় এবং একজন ব্যতিক্রমী আবৃত্তিকার– ওই এখন যাকে বলা হয় বাচিক শিল্পী। ‌ রেলওয়ে ওয়েলফেয়ার উইক ১৯৪০ সাল। তখন সাংস্কৃতিক প্রতিযোগিতা হত।‌ সেবার বিদ্রোহী কবিতার প্রতিযোগিতা ছিল। আর বিচারক ছিলেন স্বয়ং কবি কাজী নজরুল ইসলাম। সেই প্রতিযোগিতায় প্রথম স্থানের সম্মান অর্জন করে নজরুলের হাত থেকে পুরস্কার নিয়েছিলেন সত্যনারায়ণ মুখোপাধ্যায়। শিক্ষার প্রথম পর্যায়ে ও পড়ত হার্ণেট স্কুলে। আর আমি সতীশ নন্দী প্রাথমিক বিদ্যালয়ে। ফোরের বৃত্তি পরীক্ষার পর ও চলে যায় হালিশহর হাইস্কুলে। শিক্ষক সাংবাদিক গৌরীপদ গাঙ্গুলীর খুব ঘনিষ্ঠ হয়ে ওঠে। আমরা সকলেই গৌরীপদ গাঙ্গুলীকে ডাকতুম গৌরীদা। উল্লেখ্য, আমি কিন্তু তখন পড়তুম কাঁচরাপাড়া হাইস্কুলে। যেটি পূর্ববর্তীতে হোগলাপাতা স্কুল বলে পরিচিত ছিল। আমার পিতা ছিলেন ওই স্কুলের প্রতিষ্ঠাকালীন শিক্ষক। আমরা উদ্বাস্তু ছিলাম। উদ্বাস্তুদের জন্য তৈরি হয়েছিল। জমি দিয়েছিলেন মান্ধারী মিস্ত্রী। স্কুলটির পত্তন হয়েছিল কবরস্থান সংলগ্ন ২ নং জলের ট্যাঙ্ক ময়দানে।সে এক অন্য ইতিহাস।

ঋষি বঙ্কিম কলেজে আমরা একসঙ্গে পড়তুম এবং অনিবার্যভাবে বামপন্থী রাজনীতি করতুম। ততদিনে ও হয়ে গিয়েছে কলা বিভাগের ছাত্র। আর আমি বিজ্ঞান বিভাগের ছাত্র। কলেজ ইউনিয়নের রাজনীতিতে তখন আমরা নেতা না হলেও সর্বক্ষণের কর্মী এবং সঙ্গী। পরের জীবনে তো আরেক গল্প।

লেখক সুব্রত তো সমরেশ বসু ভক্ত। তার অনুপ্রেরণা তারাশঙ্কর। ৭মে,২০১৯ হালিশহর পৌরসভার হেরিটেজ কমিটি প্রদত্ত সংবর্ধনা সভায় সে তো একথা প্রকাশ্যেই বলেছিল। হালিশহরের মাটির সাহিত্য সংস্কৃতির উর্বরতার কথাও সে বলেছিল। কমিটির সভাপতি পৌরপ্রধান রবীন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায় স্বাগত ভাষণ দেন। সেদিন সুব্রতকে নিয়ে স্মৃতিচারণ করেন গৌরীপদ গাঙ্গুলি, তার সাহিত্যের বাঁক নিয়ে আলোচনা করেন বাঁধন সেনগুপ্ত,অলোক মৈত্র তার সাহিত্যে বাস্তবতা ও দর্শনের দিকটি তুলে ধরেন।

ওর মাধ্যমেই আমার সমরেশ বসুর সঙ্গে পরিচিতি। ‌ওর তো সেখানে অবাধ যাতায়াত। নৈহাটির ১ নম্বর প্ল্যাটফর্মের সেই রেল রেস্তোরাঁ। আর ঋষি অরবিন্দ রোডের বসন্ত কেবিন ছিল সমরেশ বসুর আড্ডা। বসন্ত কেবিনে সেই প্রখ্যাত সমালোচক লেখক সমরেশ বন্ধু সরোজ বন্দ্যোপাধ্যায়ও আসতেন। আসতেন অশোক সেনগুপ্ত। সেসব আড্ডা ভোলা যায় নাকি! সত্তর দশক, সমরেশ বসুর প্রজাপতি বিবর উপন্যাস নিয়ে আমরাও বিতর্কে মেতেছিলুম।

এরই মধ্যে সুব্রত ঢুকে গেল দেশে এবং অনেকের চক্ষুশূলও হয়েছিল সে। দেশ সম্পাদক সাগরময় ঘোষের ডান হয়ে উঠেছিল নাকি সে। ‘রসিক’ লিখে সে সাড়া ফেলে দিয়েছিল। পরবর্তীতে ‘রসিক’-এর নাট্যায়ন মঞ্চস্থ করেছিল নান্দিকার। সেই যে লাইন, যতদূর মনে পড়ে ‘মালিনী লো সই, সারারাত ফুল কুড়োলি,পয়সা পেলি কই!’ এই উপন্যাসের জন্য সে বঙ্কিম পুরস্কারে সম্মানিত হয়। সেটা ১৪ অক্টোবর,১৯৯৮ সাল।তার আগে ১৯৮৯ সালে অর্জন করে সমরেশ বসু পুরস্কার। সে-ই এই পুরস্কার প্রথম অর্জন করে।
আর ১৯ ফেব্রুয়ারি,২০১৩ সালে এই অঞ্চলকে মর্যাদায় উন্নীত করে সে। সেবার সে অর্জন করে সাহিত্য একাডেমী পুরস্কার রাষ্ট্র পতির হাত থেকে ‘বীরাসন’- এর উপন্যাসকার হিসেবে। তার আগে বা এই লেখার কাল পর্যন্ত এই জেলায় অন্য কোন সাহিত্যিক এতো বড় মাপের পুরস্কার অর্জন করেননি।

কাঁচরাপাড়ার আবহ সাহিত্য চক্রে সে ছিল নিয়মিত পাঠক। অতন্দ্র পত্রিকায় সে লিখেছে। সে অত্যন্ত উঁচু মাপের লেখক হলেও সাধারণ স্তরে ছিল তার মেলামেশা। অত্যন্ত সদালাপী সাহজিক ব্যবহার ও আচরণের মূর্ত প্রতীক ছিল সে।

২০১১ সালে আঞ্চলিক ঈশ্বর গুপ্ত পুরস্কারটি প্রদান করে তাকে সম্মানিত করে ঈশ্বর গুপ্ত পরিষদ।

লেখক হিসেবে আমাকে মর্যাদা দিয়েছে সে। বিজপুর মুখোমুখি’ পত্রিকায় একসময় ‘হালিশহরের উপাখ্যান’ শীর্ষকে নিয়মিত লিখেছে। সে বলেছে, তোর ওই ‘একদা একদিন’-এ অনুপ্রাণিত হয়েই আমার এই লেখা। সে একসময় জানতে চেয়েছিল এই অমল বিশ্বাস লোকটি কে? কোথায় থাকে? আমি বলেছিলুম, ও তুই চিনবি না। কল্যাণী থাকে। তা, উনি কাঁচরাপাড়া হালিশহরের খবর এতো জানে কি করে? ওনার লেখার হাতটি বেশ। আমার প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘মানুষ’ পড়ে সে আমায় বলত, “এই মানুষ! কেমন আছিস?”

পরে সে ব্যারাকপুরে চলে যায়। কিন্তু জগদীশ দা,হৃষী দা, বাঁধন দা কেমন আছে তা সে জানতে চাইত।

কর্মজীবনে সে মহকুমাশাসক ছিল। কল্যাণীতেও তাঁর পোস্টিং হয়েছিল। কল্যাণীতে যখন টাউন রেল চালু হয় লাইন পাততে বস্তি উচ্ছেদ করা হয়েছিল। উচ্ছেদ-নাগরিকদের পুনর্বাসনে সে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা নিয়েছিল।

সে লিখেছিল ‘পুরনো পথের রেখা’ ‘পৌর্ণমাসি’ ‘মধুকর’ ‘সন্ত্রাস’ ‘ বণিক’ ‘চরমপত্র’ ‘পরিখা’ ‘কালাধান’ ‘নিখিলের অন্ধকার’ ‘পাখি’ ইত্যাদি উপন্যাস।তাঁর গল্পগ্রন্থ ‘যে দেশেতে রজনী নাই’ ‘আব্দুল‌ রহিম’। তাঁর একটি উল্লেখযোগ্য ব্যতিক্রমী ভ্রমণ গ্রন্থ রয়েছে ‘খুঁজেফেরা’। আত্মজীবনীও সে লিখেছে। একটি খণ্ড অসমাপ্ত রয়ে গিয়েছে। রামপ্রসাদকে নিয়ে অদ্ভুত পরিবেশ তৈরি করেছে সে লেখায়।

সুব্রত লেখায় ছিল অন্যজগতের আয়োজন। পুরুলিয়ায় টাঁঢ় মাটিতে রসিক জীবনের উত্থান পতন,হাসিকান্নার স্বর সে শুনতে সে পেয়েছিল।বীরসন-এ সে এক অভিজ্ঞতা। আসলে ধরাবাঁধা একের বাইরে চিন্তন-জিজ্ঞাসা-গবেষণামূক বৈশিষ্ট্যে সে নির্মাণ করতো জীবন।

যদিও ফোনে আলাপ আলোচনা হয়েছিল কয়েকবার, তবে তার সঙ্গে আমার শেষ মুখোমুখি দেখা লেনিন সরণির নন্দী বাড়িতে। সেদিন ছিল সাহিত্যিক জগদীশ মুখোপাধ্যায়ের স্মরণ সভা। সে বলেছিল, “জগদীশ দা অতন্দ্রতে আমার লেখায় একটু কাটছাঁট করে দিয়েছিল। আমি কিন্তু তেমন কিছু মনে করিনি।”

সুব্রত আগুনের কাছে পৌঁছে গিয়েছে। আমি ধূসর স্মৃতি নিয়ে নদীধারে বসে ছোট্ট ছোট্ট ঢেউ গুণছি, তখন একটি চিতা জ্বলছে। সুব্রতর শরীর থেকে রজনীগন্ধার অজস্র মালা খুলে ফেলা হচ্ছে। সন্ধ্যা হয় আসছে। ফুল ছেড়ে ফুলকির দিকে চলে গেল সুব্রত।