অবতক- এর বিশেষ প্রতিবেদন :
২৮ জুলাই মহাশ্বেতা দেবীর প্রয়াণ দিবসঃ তাঁকে স্মরণ
মহাশ্বেতা দেবী কাঁচরাপাড়ায় এলেন এবং কাঁচরাপাড়ার জন্য কলম ধরলেন
তমাল সাহা
জীবনের প্রান্তিক বেলায় এসে মহাশ্বেতা দেবী বিতর্কিত হয়ে পড়েন।
রাজনৈতিক ভাবে তিনি কমিউনিস্ট আদর্শে বিশ্বাসী হলেও শেষ জীবনে দক্ষিণ পন্থার শিকার হয়েছিলেন নিশ্চিত।
তিনি যে রাজ্য শাসককে ফ্যাসিবাদী বলে প্রকাশ্যে ঘোষণা করেছিলেন তার কাছেই সেই শাসকের দলীয় আমন্ত্রণেই তাঁকে বারবার ছুটে যেতে দেখা গেছে।
রাজ্য শাসকদলের ২১ শে জুলাই শহিদ দিবস নামক সমাবেশে তিনি গিয়েছেন, সংবর্ধিত হয়েছেন, বহুবার শাল উপঢৌকন পেয়েছেন। দক্ষিণপন্থী এই শাসক তাঁকে নিশ্চিত পণ্য হিসেবে ব্যবহার করেছে।
তাঁর মৃত্যুর সময়ে যে শবর বাহিনীর উপস্থিত থাকার কথা ছিল তারা সেভাবে তাঁর মরদেহের কাছে পৌঁছাতে পারেনি। যে জনগণ এবং আদিবাসী সমাজের জন্য তিনি কাজ করেছিলেন, জীবনের শেষ মুহূর্তে তিনি তাদের ঘনিষ্ঠতা থেকে নিশ্চিত ভাবে বঞ্চিত হন। যদিও সরকারি প্রহরায় গান স্যালুট দিয়ে তাঁকে দাহ করা হয়।
মহাশ্বেতা দেবী ভারতবর্ষের সাহিত্য জগতে এক উল্লেখযোগ্য নাম। পিছিয়ে পড়া জনজাতি, আদিবাসী, অন্ত্যজ সমাজের জন্য তিনি তাঁর কলমকে শাণিত করেছেন। তাঁর এক একটি উপন্যাস নিশ্চিত ভাবে আমাদের কাছে এক একটি উজ্জ্বল উদ্ধার। তাঁর এই অবদানকে আমরা নিশ্চিত অস্বীকার করতে পারিনা
তাঁরই সহোযোদ্ধা জীবন সাথী ‘নবান্ন’ স্রষ্টা নাট্যকার, অভিনেতা বিজন ভট্টাচার্য এবং তেজি পুত্র কবি- সাহিত্যিক নবারুণ
ভট্টাচার্য। পিতা কবি মনীশ ঘটক– যুবনাশ্ব। কাকা সেই বাঁধনহীন চলচ্চিত্রকার ঋত্বিক ঘটক।
এবার তাঁর কাঁচরাপাড়ায় আগমন নিয়ে লিখি।
একান্ত কাঁচরাপাড়ার এই মহাশ্বেতাকে কাঁচরাপাড়ায় প্রথম এনেছিলেন ১৯৮২ সালে তখনকার বিজ্ঞান দরবারের সম্পাদক সুকুমার রায়।
‘স্বেচ্ছা সৈনিক’ এই ‘হাজার চুরাশির মা’ পশ্চিমবঙ্গ হরিজন কল্যাণ সমিতির সঙ্গে সক্রিয়ভাবে যুক্ত ছিলেন। তিনি এক ডাকে সাড়া দিয়ে এসেছিলেন কাঁচরাপাড়ায়।
১৯৮২ সাল। হরিজন পাড়ায় পুরোদমে চলছে মদ্যপান বিরোধী আন্দোলন। প্রথম সারির সৈনিক রাজেন্দ্র বাঁশফোড়। খুন হয়ে গেল ১২ ফেব্রুয়ারি ১৯৮২। মহাশ্বেতা দেবী খবর পেয়েই ছুটে এলেন। আবার তিনি এলেন ৭ আগস্ট ১৯৮৫। কাঁচরাপাড়া মহাত্মা গান্ধী হরিজন প্রাথমিক ইস্কুলে। তখন চলছে বীজপুর হরিজন মহিলা সমিতির সম্মেলন।
বীজপুরের হরিজনদের উপর অত্যাচারের প্রতিবাদ জানিয়ে মুখ্যমন্ত্রী জ্যোতি বসুর কাছে চিঠি লিখলেন ২৮ ফেব্রুয়ারি ৮৫। বীজপুরের সঙ্গে যুক্ত হয়ে পড়লেন মহাশ্বেতা। তিনি কাঁচরাপাড়ার জন্য কলম ধরলেন ১৯ এপ্রিল ১৯৮২। যুগান্তরে লিখলেন, ‘৩০ মার্চ– কাঁচরাপাড়ায় ডাঙ্গাপাড়ায় ধোবিপুকুর রোডের হরিজন বস্তিতে আরেক রকম শোকের চেহারা দেখলাম। কাঁচরাপাড়া হরিজন শব্দের আধারে ধরা আছে দুসাদ, রবি দাস, ধোবি, পাশোয়ান, ডোম, হেলা হালভি, লাল, বেগি, কদমবংশি, রাউথ, বল্মীক এমন নানা জাতির মানুষ হাজারে হাজারে।
ডাঙাপাড়ার ধোবিপুকুর রোডের প্রায় ৫০০ পরিবার আছেন। জনসংখ্যা কয়েক হাজার। এদের জন্য একটি নলকূপ। জলের কল আছে। তাতে জল পড়ে সরু ধারে। জাতির জনকের প্রিয় মানুষেরা বাস করে খালধার পৌরসভা সুইপার কলোনিতে, কালিতলা সুইপার কলোনিতে, ইটখোলা স্টোর ব্লকে, ভূতবাগান কলোনিতে, ডানলপ ঘাটে শ্মশানের কাছে। … পশ্চিমবঙ্গ হরিজন কল্যাণ সমিতি কাঁচরাপাড়ার পিছনে আছে দীর্ঘ সংগ্রামের ইতিহাস। … এইসব যুবকদেরই একজন ছিল রাজেন্দ্র বাঁশফোড়। সে থাকতো তার দিদিমার কাছে। মদের ঠেক তুলে দিয়ে সে তো আনন্দে উল্লাসে সাবধান হতে ভুলে গিয়েছিল। আর ১২.২.৮২ রাত ১১:৩০ মিনিটে তাকেই তুলে নিয়ে গিয়েছিল সেই “কে বা কাহারা”। তাকেই তো “ববুয়া রে” বলে আর্ত ডেকে উঠেছিল দিদিমা। তার মাসি ছুটেছিল থানায়। নন্দকিশোর ও অন্য ছেলেরাও ছুটেছিল। থানা যদিও দশ পনেরো মিনিটের পথ পায়ে দৌড়লে, … তবু পুলিশেরও জিপ এসেছিল রাত দেড়টায়। তার ঘর থেকে দু চার মিনিটের কম লাগে এক গির্জায় পৌঁছাতে। সেখানেই মেলে রাজেন্দ্রকে।
না। কোনো হিংসা নয়, কোনো অস্ত্র নয়, ঘাস মাড়াবার ভারি রোলারটি বুঝি ওর ওপর দিয়ে চালানো হয়েছিল। রাজেন্দ্রর দিদিমার চোখে আমি আরেক রকম শোক দেখলাম। … এই শোক সবচেয়ে ভয়ঙ্কর। এই বাধ্য হয়ে মেনে নেওয়ার ব্যাপারে বুক জ্বলে যায়। তার সে দাহনের জ্বালা আমাকে এখনও জ্বালাচ্ছে।’
ওহে মারাংদাই! তুমি তুলেছিলে উলগুলানের সুর,লিখেছিলে অরণ্যের অধিকারের কথা, দেখিয়েছিলে অপারেশন বসাই টুডুকে, চিনিয়েছিলে চোট্টি মুন্ডা ও তার তীর। একদিন রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে তোমার হাতের কালি নিঃসৃত ধাতব ফলা থেকে নির্গত শব্দগুলি ছুটে যেতো টংকার ধ্বনি তুলে তীরন্দাজী বাণের মতো। তুমি বলেছিলে,মরণ বোলায়ে কিছু নাই হে কমরেট, বাঁচাটো নিয়েই যত গোলমাল!
শাসক তোমার শবদেহকে করলো পণ্য, গান স্যালুট দিয়ে লুটে নিল তোমাকে।
মারাংদাই! তুমিই বলো কে রুদালি?
তুমি এই শহরে পা রেখেছিলে কোনোদিন!!