অবতক খবর,৭ জুলাই,মলয় দে নদীয়া:-রথযাত্রা মানেই জগন্নাথের মাসির বাড়ি যাত্রা। মহিষাদল থেকে পুরী, রথযাত্রা ঘিরে আপামর ভক্তরা মেতে উঠলেও রথের ছবিটা যেন একেবারেই অন্যরকম অদ্বৈতভূমি শান্তিপুরে। প্রায় ৩৫০ বছর আগে বড় গোস্বামী বাড়ির হাত ধরে শুরু হওয়া শান্তিপুরের রথযাত্রায় আজও আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দু রামচন্দ্রই।

কাঠের রথ নয়, লোহার তৈরি রথেই জগন্নাথ বলভদ্র ও সুভদ্রাকে নিয়ে মাসির বাড়িতে যাত্রা করেন রঘুনাথ। শান্তিপুরের বড় গোস্বামী বাড়ির রথকে ঘিরে রয়েছে নানা জনশ্রুতি। রয়েছে ঘুড়ি খেলার সুদীর্ঘ ইতিহাসও।

হস্তচালিত তাঁত শিল্পের পীঠস্থান শান্তিপুর যেন এক উৎসব নগরী। শাক্ত-বৈষ্ণবের মিলনস্থল কয়েকশো বছর পুরনো এই প্রাচীন জনপদের দক্ষিণ দিকে বয়ে গিয়েছে পুণ্যবাহিনী ভাগীরথী। রাস উৎসবের জন্য এই শহর বিখ্যাত হলেও বারো মাসে কোনও পার্বণই বাদ পড়ে না। শান্তিপুরের রথযাত্রাতেও রয়েছে নিজস্বতা।

মূলত বড় গোস্বামী বাড়ির রঘুনাথের রথযাত্রাকে কেন্দ্র করেই মেতে ওঠেন শান্তিপুরের আপামর বাসিন্দা। বড় গোস্বামী বাড়িতে যে রঘুনাথ জিউকে কেন্দ্র করে এই রথযাত্রা শুরু হয়, তার মূর্তিটি রামচন্দ্রের প্রচলিত মূর্তির তুলনায় বেশ অনেকটাই ভিন্ন। এখানে রামচন্দ্র পদ্মাসনে উপবিষ্ট। ধুতি পরিহিত, গায়ে থাকে চাদর। রঘুনাথের গ্রাত্রবর্ণ সবুজ।

কীভাবে বড় গোস্বামী বাড়িতে রঘুনাথের বিগ্রহ এল, তা নিয়েও রয়েছে নানা উপকথা। জনশ্রুতি অনুযায়ী, পরাধীন ভারতবর্ষের আইসিএস অতুলচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের শান্তিপুরের বাড়িতে নাকি একসময় নিত্য পূজিত হতেন রঘুনাথ। প্রায় ৩৫০ বছর আগে চট্টোপাধ্যায় পরিবার যখন শান্তিপুর থেকে চলে যায়, তখন রঘুনাথ বিগ্রহকে অদ্বৈতাচার্যের বংশধর বড় গোস্বামীদের হাতে তুলে দেওয়া হয়। তখন থেকেই শান্তিপুরে শুরু হয় রথযাত্রা।

বড় গোস্বামী বাড়ির বর্তমান বংশধর সত্যনারায়ণ গোস্বামীর কাছে শোনা গেল রঘুনাথের রথযাত্রার নানা কথা। পুরী, মহিষাদলের মত উল্লেখযোগ্য রথগুলোর প্রত্যেকটিই কাষ্ঠ নির্মিত হলেও শান্তিপরে রঘুনাথের রথ লোহার তৈরি। রথের উচ্চতা প্রায় ৩৫ ফুট। প্রায় ১০০ বছর আগেও নাকি এর উচ্চতা ছিল ৫০ ফুটেরও বেশি।

যা পরবর্তীতে কমিয়ে আনা হয়। রথের শীর্ষদেশে বৃহত্তর চূড়ায় রঘুবীর সহ জগন্নাথ, সুভদ্রা ও বলভদ্র উপবিষ্ট হন। কাপড়, ঝালড় দিয়ে সুন্দরভাবে রথকে সাজানো
হয়।

আষাঢ়ী শুক্ল দ্বিতীয়া তিথিতে সকাল বেলা বড় গোস্বামী বাড়িতে রামচন্দ্রকে হাউদায় বসিয়ে বিশেষ পুজো করা হয়। খোল, করতাল, শঙ্খ, উলুধ্বনিতে মুখরিত হয় ওঠে বড় গোস্বামী বাড়ির রথপ্রাঙ্গণ। রথের কাছে দেব বিগ্রহগুলিকে নিয়ে আসার পর সেখানে তাঁদের নৈবেদ্য নিবেদন করা হয়। এরপর কীর্তন করতে
করতে দেব মুর্তিগুলি নিয়ে ভক্তেরা রথের চারিদিক পরিক্রমা করেন। সবশেষে রামচন্দ্রকে চেনপুলির সাহায্যে রথের সর্বোচ্চ চূড়ায় তোলা হয়।

এরপর শুরু হয় রথযাত্রা। মূলত ন’টি চূড়া এবং ন’টি লৌহনির্মিত বিশালাকার চক্রবিশিষ্ট এই রথ শহরের রাজপথে নামতেই তাকে ঘিরে হাজার হাজার ভক্তের ভিড় উপচে
রয়েছে ঘুড়ি খেলার সুদীর্ঘ ইতিহাস
বড় গোস্বামী বাড়ী।

বড় গোস্বামী বাড়ির বর্তমান সদস্যরা বলেন, শাস্তিপুরে রঘুনাথের পৃথক কোনও গুন্ডীচা মন্দির নেই। তাই গর্ভমন্দিরে যেখানে রঘুনাথ সারাবছর থাকেন, সেই মন্দিরের পাশেই অস্থায়ী মাসির বাড়ি তৈরি করে রামচন্দ্র সহ জগন্নাথ, বলভদ্র ও সুভদ্রাকে দ্বিতীয়া থকে নবমী পর্যন্ত রাখা হয়।

দশমীর দিন পুণ্যযাত্রার মাধ্যমে আবার দেবতারা নিজ মন্দিরে প্রত্যাবর্তন করেন। রঘুনাথের রথযাত্রার ভোগ নিবেদনেও রয়েছে বিশেষ রীতি। উল্টো রথের আগের রাতে বিগ্রহদের দ্যাওড়া ভোগ দেওয়া হয়। ভোগের অন্যতম উপকরণ কলমি শাক ও দই।
এই রথকে কেন্দ্র করেই বড় গোস্বামী পাড়ার রথতলা থেকে মাতা আগমেশ্বরী দেবীর মন্দির পর্যন্ত বিশাল মেলা বসে।

শুধু মেলা নয়, শান্তিপুরের রঘুনাথের রথযাত্রা মানেই ঘুড়ির উৎসব। রথের দিন সকাল থেকে শুরু হয় মাঠে-মাঠে ঘুড়ি ওড়ানোর । চলে প্যাঁচ খেলার লড়াই।