আজ সেই উল্লেখযোগ্য বিশ্বনারী দিবস, যেদিন জোয়ান অব আর্ককে একবার নয়,মোট তিনবার আগুনে পুড়িয়ে মারা হয়েছিল।
অবতক-এর বিশেষ প্রতিবেদনঃ
মিউজ নদী তীরে আগুনের পাখি
তমাল সাহা
মেয়েরা এভাবে ক্রমাগত নারী হতে থাকে আমার চোখের তারায়। হাজার হাজার বছর ধরে আমি নারীদের দেখি,রমণীয় নারীরা বীর যোদ্ধা হয়ে ইতিহাস লিখতে থাকে। আমি নারীদের ইতিহাস খুঁজতে থাকি। কোথায় কত নারী আছে তাদের ভালোবাসা যায়!
হে প্রিয় নারীরা আলিঙ্গন করো আমায়।
মিউজ নদীর তীরে সেই তুমি আজ এসে দাঁড়াও আমার চোখের পাতায়। বাবা জেকোর কাছে খামারের কাজ শিখেছিলে তুমি। মা ইসাবেলের কাছে সেলাই ফোঁড়াইয়ের কাজ। কিন্তু কি করে শিখেছিলে রণকৌশল,যুদ্ধের পদ্ধতি সে এখনো আমি জানিনা। সেই কবে থেকে কিশোরী তুমি! বয়স তো মাত্র তেরো। আমাকে আকর্ষণ করো।কত কি জেনে যাও দেশের মুক্তির কথা।
মেষশাবকেরা বেড়ে উঠছিল,ঘাস খাচ্ছিল চারণ ভূমে তোমার তদারকি পাহারায়।সেই মাঠে নাকি হয়েছিল দৈববাণী– তুই হবি দেশের মুক্তিকামী নারী।
আসলে দৈববাণীর চেয়ে বিশ্বাস হয়ে উঠেছিল বড়। সেই বিশ্বাসের কাছে তুমি আত্মত্যাগের মন্ত্র শিখলে, দৈববাণীর চেয়ে দেশের মুক্তি সাধনা হয়ে গেল প্রগাঢ়।
সাদা পোশাক কেন পরেছিলে তুমি? কেন হয়েছিলে সাদা ঘোড়ার সওয়ারি? বা হাতে কেন তুলে নিয়েছিলেন পঞ্চক্রুশধারী তরবারি? এখনো এসব আমি ভাবি। এসবের মধ্যে কি কোনো শুদ্ধতা লুকানো ছিল?
সে তো ২৮ এপ্রিল ১৪২৯ সালের ঘটনা। তখনো তুমি হওনি নারী, কেবলই কিশোরী আমার চেতনায় আনে উন্মাদনা। শতবর্ষ ব্যাপী যুদ্ধ ও একটি মেয়ের নাম, জাতির উত্থান, স্বাধীনতা আমরা জানতে পারি। বিশ্বাসঘাতক কাকে বলে, কাকে বলে বিচারের প্রহসন–তোমার জীবন থেকে শিখলাম। আবার সেই ধর্মের কথা উঠে আসে। তুমি কি ছিলে ধর্ম বিদ্রোহী অথবা ধর্ম বিরোধী? কি দোষ ছিল তোমার?
নারী হয়ে তুমি পুরুষের পোশাক ধরো?
দেশকে স্বাধীন করতে ধরো উন্মুক্ত তরবারি? অদ্ভুত তুমি!
পুরুষের বেশ ধরে সৈন্যাপত্যের নৈপুণ্য দেখাও,এই নাকি ধর্মদ্রোহ!
কারাগারে কোথায় নিরাপত্তা তোমার? তখন পরেছো নারীর পোশাক,হয়েছো ধর্ষিতা, কারাগারেও নিরাপত্তা নেই।সেই কবে থেকে নারীরা ধর্ষিতা,এর থেকে বাঁচতে আবার ধরেছিলে পুরুষের পোশাক,যাতে কামের কোন গন্ধ, যৌনতার কোন চিহ্ন না খুঁজে পায়,সেই কামুক লম্পট রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা বাহিনী।
জুরি যখন প্রশ্ন করেছিল, তোমার উপর ঈশ্বরের বিশেষ দয়া আছে, এমন বিশ্বাস আছে কি তোমার? তুমি জবাবে বলেছিলে, যদি আমি তা না করি তবে ঈশ্বর যেন আমাকে সেখানেই রেখে দেন। আর যদি বিশ্বাস করি ঈশ্বর যেন আমাকে রক্ষা করেন। এই যে কৌশলী উত্তর, ঈশ্বরের বিরুদ্ধাচারণ, ঈশ্বরের অস্তিত্বে অনস্তিত্বে বিশ্বাস জটিল করে তোলো তা কি তোমাকে রক্ষা করতে পেরেছিল? রক্ষা করতে পারেনি।
বিচারের প্রহসনে নারীরা ডাইনি হয়। এমন মহিমাময় নারীকে কি বাঁচিয়ে রাখে কোন ধর্মীয় সম্প্রদায়?
একটি কুমারীকে কি কেউ কোনোদিন পিলারে বেঁধে পুড়িয়ে মারে? পুড়ে পুড়ে অঙ্গার হয়ে গিয়েছিল তোমার দেহ। যেন বিন্দুমাত্র অস্তিত্ব না থাকে, আবার দুবার পোড়ানো হলো তোমাকে, পুড়ে করে ফেলা হলো মিহি ছাই। সেই ছাই উড়ে গেল বাতাসে বাতাসে।
কেন পোড়ানো হয়েছিল তিনবার তোমাকে? যেন কোন ছাই মানুষ মুঠো করে সংগ্রহ করতে না পারে।
ছিলে জোয়ান অব আর্ক, হয়ে গেলে আগুনের পাখি। তোমাকে আজও বুকে আগলে দিয়ে রাখি।