অবতক খবর, ১৬ জুন :: হুকুম চাঁদ জুট মিলের প্রতিবাদী শ্রমিক পারশনাথ প্রসাদ হাপিস হয়ে গিয়েছে। একবছর হলো তাঁর কোন তালাশ নেই। এর আগে তেলেনিপাড়া জুটমিল থেকে হাপিস হয়ে গিয়েছিল ভিখারি পাশোয়ান। তাঁরও কোন খবর নেই। ভিখারি পাশোয়ানকে সামনে রেখেই বর্তমানের মা মাটি মানুষের সরকার ক্ষমতায় এসেছিল।
পারশনাথের ভাই সুরেন্দ্র প্রসাদ জানান,পারশনাথকে লেবার দপ্তরে ডাকা হয়েছিল। তারপর থেকেই তার হদিশ নেই। সুরেন্দ্র প্রসাদ থানায় অভিযোগ জানাতে গেলে তাঁকেও শাসানি দেয় পুলিশ। বহু ছোট ছুটি করার পর চাপে নাজেহাল মিলের ম্যানেজমেন্ট শেষ পর্যন্ত পারশের নামে মিসিং ডায়েরি করতে বাধ্য হয়। কিন্তু তার FIR নিতে রাজি হয়নি। এখনও পর্যন্ত তাঁর কোনো খোঁজ মেলেনি।
হুকুম চাঁদ জুট মিল এখন গল্প কথা। একসময়ে এই মিল এশিয়ার বৃহত্তম জুটমিল বলে বারফাট্টাই ছিল। শতাব্দী প্রাচীন এই জুট মিল। এই অঞ্চলের জুটমিলকে কেন্দ্র করে উল্লেখযোগ্য তিনটি উপন্যাস আছে। বিটি রোডের ধারে, জগদ্দল, শেকল ছেঁড়া হাতের খোঁজে। লিখেছিলেন এই অঞ্চলেরই অন্যতম লেখক উপন্যাসকার সমরেশ বসু। তিনি নিজেও কাঁকিনাড়া জুট মিল এবং ইছাপুর রাইফেল ফ্যাক্টরিতে মজদুরের কাজ করতেন। পরবর্তীতে এই অঞ্চলের অন্যতম গল্পকার জ্যোৎস্নাময় ঘোষ শ্রমিক জীবনকে কেন্দ্র করে এক উপাখ্যান লিখেছিলেন।
এই অঞ্চলের উল্লেখযোগ্য শ্রমিক নেতৃত্বরা ছিলেন বঙ্কিম মুখার্জি,মহঃ ইসমাইল, শান্তি ঘটক, মহঃ আমিন, গোপাল বসু ,সন্তোষ কুমারী গুপ্তা ,সুধারায়, মৈত্রেয়ী বসু, রেণু চক্রবর্তী প্রমুখ। ১৯৫২ সাল। হুকুম চাঁদ জুট মিলে জোর লড়াই বোনাসের দাবিতে। ছুটে এসেছিলেন কবি পারভেজ শাহেদি। নেলসন রোডে মসজিদের সামনে মঞ্চ।
হুকুম চাঁদ জুট মিলের বর্তমান মালিক শরৎ জেটিয়া ও রাঘবেন্দ্র গুপ্তা। সেই যে প্রখ্যাত শিল্পপতি অরুণ বাজোরিয়ার আত্মীয় । বাজোরিয়াজি এখন প্রয়াত। দীর্ঘ বছর ধরে মিল ম্যানেজমেন্টের দায়িত্বে আছেন এস. চন্দ্রা। এই মিলে চলছে চন্দ্রার একনায়কতন্ত্র, এমনই মজদুরদের অভিযোগ। এই চন্দ্রা সাহেবের বয়স প্রায় 76 বছর অতিক্রান্ত অথচ তার অবসর নেই কিন্তু তার জুলুমবাজি রয়ে গিয়েছে। মালিকের বিরুদ্ধাচারণ করলেই শ্রমিকদের গেট বাহর অর্থাৎ কাজ থেকে তাড়িয়ে দিচ্ছে মিল কর্তৃপক্ষ ।
জুটমিলে বদলি ভাগা ভাউচারওয়ালা স্থায়ী তিনটি শব্দ। পর যুক্ত হয় শূন্য নাম্বারের শ্ৰমিক। তবে এখন সম্পূর্ণ মিল চালাচ্ছে কন্ট্রাক্টররা। এক কথায় বললে মিল মালিকের অর্থাৎ চান্দ্রা সাহেবের দালাল রা। চন্দ্রার আতঙ্ক এমন যে এখন একটি নতুন শব্দ ভীষণ প্রচলিত । শ্রমিক প্রতিবাদ করলেই ‘গেট বাহার’। এই শব্দটি এখন প্রতিনিয়তই শোনা যাচ্ছে এখানে।
শ্রমিকনেতারা সে যে রাজনৈতিক দলেরই হোক তারা মালিকের এই জুলুমবাজির বিরুদ্ধে নিশ্চুপ। শ্রমিক স্বার্থের কোন লড়াই নেই। ম্যানেজমেন্টের খবরদারি এতই ভয়ঙ্কর মে, মা-মাটি-মানুষের শ্রমিকনেতা অর্থাৎ INTTUC নেতা তাপস গুপ্তা এবং সাংসদ অর্জুন সিংহ প্রিয় ধীরাজ ঝাঁকে পর্যন্ত গেট বাহার করে দিয়েছে এই ম্যানেজমেন্ট। শ্রমিকদের সরকারি রেট মজুরি রোজ 370 টাকা নির্ধারিত কিন্তু শ্রমিকদের প্রশিক্ষণের নাম করে মজুরি কেটে দেওয়া হচ্ছে মাত্র 180 টাকা।
শ্ৰমিকদের হয়ে কথা বলার জন্য মিল থেকে গেট বাহার করে দেয়া হয়েছিল তৃণমূল শ্রমিক নেতা জয়দেব পুরিকে। ৫ মাস তাকে মিলে ঢুকতে দেয়নি মিল কর্তৃপক্ষ। কোনো নেতা বিধায়ক ধরেও কোনো লাভ হয়নি অবশেষে তৃণমূলের থেকে আস্থা হারিয়েছেন এই শ্রমিক নেতা।
কোর্ট- ট্রাইব্যুনালে জিতেও মজুর সুরেন্দ্র প্রসাদ অসহায়। ট্রাইব্যুনালের রায় তার বকেয়া ৪ লক্ষ ৭৭ হাজার টাকা কর্তৃপক্ষকে মিটিয়ে দেওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। কিন্তু তা আর কার্যকরী হচ্ছে না। মালিক বলছে এখানে শ্রম দেবার উপযোগী শ্রমিক নেই। এদিকে মজুরেরা রোজই আসছে,কাজ না পেয়ে ফিরে যাচ্ছে।
এখন প্রশ্ন শ্রমিক নেতারা কি কেনাবেচা হয়ে গিয়েছে ? জুট মিলের জন্য মায়াকান্না কেঁদেছেন ব্যারাকপুরের সাংসদ। তিনি দলবদলু শ্রমিক নেতায় পরিণত হয়েছেন। তার দলের লোকেরাই কখনো তাকে বলেছেন সর্দার, পরে গদ্দার নামে অভিহিত হয়েছেন। আবার তিনি সেই দলেরই সর্দার হয়ে গিয়েছেন। কিন্তু শ্রমিকের অবস্থার কোন উন্নতি নেই।
সুবোধ অধিকারী বিধায়ক হবার পর হালিশহর পৌরসভার চেয়ারম্যান রাজু সাহানি,নৈহাটি পৌরসভার চেয়ারম্যান অশোক চ্যাটার্জী এবং মালিক এস. চন্দ্রার সঙ্গে বৈঠক করেন । তাতে সরাসরি বলা হয়েছিল শ্রমিকদের স্বার্থ দেখা হবে। বছর পার হয়ে যায়। শ্রমিকদের অধিকারের কথা বাদ দিন ,তার দলের শ্রমিক নেতাদের খোঁজ খবর নেয়া ভুলে গেছেন বিধায়ক। শ্রমিকরা অসহায়, নিরুপায়। তাদের সম্বল এখন চোখের জল। নেতারা দেখেই চলেছেন– দেখো! সার্কাস দেখো। মজদুররা এখন অত্যাচারে জর্জরিত আতংকিত আর যে নেতারা শ্রমিকদের হয়ে বুলি ঝেড়ে ছিলেন তারা এখন ঠান্ডা ঘরে চান্দি কাটছেন।