আজ আমাদের নেড়াপোড়া
তমাল সাহা
ছোটবেলা কে আর অত মানে জানে? সবাই বলতো আমরাও তাই বলতুম- নেড়াপোড়া।
দোলের আগের দিন কাঠকুটো, গাছের ডালপালা, খড়ের নুড়ো–এসব জড়ো করে স্তূপ বা বাড়ির আকারের রূপায়ণ! সেই সকাল থেকে তার প্রস্তুতি, সে কী তোড়জোর! কেউ বলতো বুড়ির ঘর।
সন্ধ্যার আকাশে পূর্ণ গোল চাঁদ হলুদ বর্ণ থেকে সাদা জোছনার দিকে এগিয়ে যায়। তখন বুড়ির ঘরে আগুন জ্বলে আর সেই সম্মিলিত ছড়া– আজ আমাদের নেড়াপোড়া/ কাল আমাদের দোল/ পূর্ণিমাতে চাঁদ উঠেছে/ বোল হরিবোল!
আর আমাদের মত এঁচোড়ে পাকাদের অতিরিক্ত সংযোজন– ফট করে ফেটে গেল বুড়ো দাদুর….
আসলে এর নাম কেন নেড়াপোড়া, কেন বুড়ির ঘর, কেনই বা দোলের আগের দিনই , দোল-ই বা কী– বড় হয়ে এসব বুঝতে শিখি।
বছরের অন্তিম ঋতু বসন্ত। মলিনতা দূরীকরণের মাধ্যমে শুদ্ধতা চাই, হৃদয়ে উদ্বেলিত হোক ভালোবাসার ছোঁয়া।
নেড়া হলো সেই মলিনতা। বোধ করি নুড়ো শব্দটি থেকে প্রচলিত। এই নুড়ো শব্দটি আমরা তো অনেক সময়ই বলি, তোর মুখে নুড়ো জ্বেলে দেব। তো বুড়ির ঘর বলে কেন? আসলে কোন বুড়ির কোনমতে টিকে থাকার ছাউনির মতো দেখায় তো এই ঘর, তাই এই নির্মাণটিকে বলা হয় বুড়ির ঘর। আসল মালিক তো ঘরওয়ালি নারীরাই, সে বোধ করি একাকী এক বুড়ি।
আর পোড়া? এই শব্দটি পুড়া থেকে আগত, অভিধান তো তাই বলে।
মনের মলিনতা দহন করে ভালোবাসার দোলনের দিকে যাত্রা। ভালবাসা তো হৃদয় জনিত দুজনের দোলন-স্পন্দন!
দোলযাত্রা ভালোবাসার দোলনের অভিমুখ। আকাশে পূর্ণিমার চাঁদ। মনকে রাঙাও ভালোবাসার রঙে। তাই তো আবির! আবির অজুহাত মাত্র। সে তো আসলে স্পর্শের মাধ্যম। না হলে এমনি এমনি কী প্রকাশ্যে পরস্পরকে স্পর্শ করা যায়! কেমন আছো গো তুমি মোর মন পাগলা ফাগুয়া!
জননীই জাতকের মন বোঝে। কৃষ্ণ তুই শ্যামল হলি কেমনে? রাক্ষসী পুতনার স্তন তিলে তিলে দংশন করে তাকে হত্যা করেছে শ্রীকৃষ্ণ। শ্রীকৃষ্ণ আর তখন কতটুকু! বিষাক্ত স্তন্যপানের এই নীলগরল মিশে গেছে তার রক্তপ্রবাহে। শ্রীকৃষ্ণের দেহবর্ণ তাই গরল নীল। আর রাধা দুধে আলতা। শ্রীকৃষ্ণকে তার পছন্দ হবে কেন, পছন্দ হবে কেন গোপিনীদের? মনের দুঃখের কথা শ্রীকৃষ্ণ জানায় জননীকে। জননী ব্যতীত কে বোঝে জাতকের দুঃখ? মা বলে, গোপাল আমার, যা ওদের সঙ্গে রং খেলগে! তোর ইচ্ছেমতো রং দিয়ে ওদের রাঙিয়ে দে। রাধা আর গোপিনীদের সঙ্গে মিশে যা! ভাবো,এক মা দিচ্ছে নারীদের সঙ্গে তার পুত্রকে মেশার আস্কারা! এই না হলে ভালোবাসা! তাই রঙের ভালোবাসা আর ভালোবাসার রঙে মাতাও মন।
আমাদের এখানে অন্যান্য প্রদেশের হোলিকা দহনের সঙ্গে নেড়াপোড়ার তুলনা করা হয়। হোলিকা এক অসুরা-নারী, অসুররাজ হিরণ্যকশিপুর ভগিনী। সেই ভগিনী ব্রহ্মার কাছে অমরত্বের শাল উপহার পেয়েছিল। পিসি হয়ে বিষ্ণুভক্ত প্রহ্লাদকে অগ্নিদাহে হত্যা করতে উদ্যোগী হয়েছিল। বিষ্ণুর কূটনৈতিক কৌশলে পিসির শালে আবৃত হয়ে গেল প্রহ্লাদ আর অগ্নিদ্ধ হয়ে মারা গেল পিসি।
হোলিকা এখানে অশুভ শক্তির প্রতীক। অশুভ দমনে শুভের জয়ের উৎসব। তাই একে বলে হোলি উৎসব।
পঞ্জাবের মুলতানে প্রহ্লাদপুরী মন্দিরের ধ্বংসাবশেষ রয়েছে। সেখানেও এই উৎসব পালন করা হয়। একে বলা হয় হোলাষ্টক উৎসব। হোলি এবং তার আগের অষ্টদিন সংযুক্ত করে এই উৎসব পালন করে জনপদবাসীরা। তাই এর নাম হোলাষ্টক উৎসব। শিখ ধর্মগ্রন্থ গ্রন্থ সাহেবে হোলিকে গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। হোলিতে ব্যবহৃত রং সমূহকে বলা হয় ঈশ্বরের করুণা।
অনেকে মনে করেন হোলা থেকে হোলি শব্দটি এসেছে। সংস্কৃত হোলকা থেকে এই শব্দের আগমন। পঞ্জাবে অর্ধপক্ক শস্যকে বলা হয় হোলকা। পঞ্জাবে এই উৎসব আগাম শস্যবরণের উৎসব হিসেবেও পরিচিত। এই উৎসবে আধপাকা গম ও ছোলা খাওয়ার রীতি প্রচলিত আছে।
এসো, রঙের উৎসবে আমরা ভালোবাসার মদ পান করি।