সুমনা আদক / অবতক খবর : যদি কেউ বলে থাকে বুদ্ধিতে বাঙালির বাজিমাৎ —-কথাটা সে কিন্তু ঠিকই বলেছে। আসলে মগজাস্ত্রের গোয়েন্দাগিরিতে বাঙালির দ্বিতীয়জুড়ি মেলা ভার, বাঙালির মগজে-মনে, পাশাপাশি বাংলা ছায়াছবিতে যিনি গোয়েন্দার ভুত চাপিয়েছেন বলতে গেলে একটা মুখই খালি ভেসে ওঠে; চোখে কালোফ্রেমের চশমা, ঠোঁটে চুরুট, গলায় গম্ভীর স্বর আমাদের তিনি মানিকবাবু, অনেকে ওনাকে রায়বাবু বলেও চিনতেন। বাংলা সিনেমা বিশেষভাবে ঋণী আমাদের মাস্টারমশাইয়ের কাছে। সালটা 1921শের 2রা মে, কলকাতার গড়পার লেনে জন্মহয়েছিল মানিকবাবু তথা সত্যজিৎ রায় মহাশয়ের, এবছরটা ওনার জন্মের শতবার্ষিকী। সাহিত্যে শার্লক হোমস, আদ্রিয়ান মংক, ফিলিপ মার্লো থাকলেও বাঙালির মনের নায়ক কিন্তু ফেলুদা। তাই ফেলুদা যখন বলতেন “সাবাশ তোপসে”, তখন তোপসে শুধু একাই নয়, সব বাঙালির মনের মধ্যেই কেমন একটা তোপসে হবার বাসনা জেগে ওঠত।
আসলে ফেলুদাকে কেবল রায়বাবুই সৃষ্টি করতে পারেন, অন্যকেউ নয়। আমাদের শৈশব-কৈশোর কেটেছিল তার সৃষ্টির হাত ধরে; ছুটির দুপুর বেলাগুলো কাটতো তারিণী খুড়ো, অপুদূর্গা, ফেলুদা, মগনলাল, তোপসে জটায়ু দের সাথে। স্কুলের বইয়ের ফাঁকে লাইব্রেরি থেকে নিয়ে আসা রায় মহাশয়ের বইগুলো গল্পের আসরটাকে আরো প্রাণবন্ত করে তুলতো। কৈশোরে অনেকটা সময় কেটেছে শঙ্কুর সাথে, পরে দেখা শুরু হয় রায়মশাইয়ের আন্তর্জাতিক সিনেমাগুলো। এতো নিখুঁত, নিপুন শিল্পকলার স্বাদ সত্যিই কোথাও পাওয়া যায় না। রবিঠাকুর, বিভূতিভূষণ বন্দোপাধ্যায়, পরশুরাম, তারাশঙ্কর বন্দোপাধ্যায়, উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরী, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, শরদিন্দু গঙ্গোপাধ্যায় থেকে মুন্সী প্রেমচাঁদ সাহিত্যিকদের সৃষ্ট চরিত্রগুলো প্রাণ পেয়েছিলো ওনার সিনেমার পর্দায়। এই অমোঘ সৃষ্টির ভিড়েও বেশ জায়গা করে নিয়েছিল তার নিজস্ব কাঞ্চনজঙ্ঘা, শাখাপ্রশাখা, জয়বাবা ফেলুনাথ, গুপীবাঘারা।
বলাবাহুল্য আজকের হাই ডেফিনেশন পিকচার কোয়ালিটির বাজারে, কোনো চ্যানেলে “পথের পাঁচলী ” দেখানো হলে তার ভিউয়ার্স হয় সবথেকে বেশি; ইন্দিঠাকুর তার ভাঙা গলায় চুম্বকের মতো দর্শককে টেনে রাখে টিভির পর্দায়। গুপীবাঘার সেই ভুতের রাজার বরে আটপৌরে বাঙালি পৌঁছায় হীরক রাজার দেশে, মনে প্রশ্ন জাগে পরশ পাথর কি আজও আছে? যদি একবার পাওয়া যেত তাহলে কিনা হতো। বিরিঞ্চিবাবা কে নিয়ে কত কল্পনার জাল বোনা হয় মনে, “চিড়িয়াখানা” দেখে আবার বৈজ্ঞানিক হবার ইচ্ছা জাগে, অশনিসংকেত, নায়কের রূঢ় বাস্তবতা সত্যিই চোখে জল আনে। আজকাল রিমেকের যুগে গুপীগাইন-বাঘাবাইন কে রিমেক বানানোর কেউ সাহস পায়না আসল কথাটা হলো গুপীগাইন-বাঘাবাইন, মহানগর, চারুলতাদের কোনো বিকল্প নেই; ফেলুদাকে নিয়ে অবশ্য কিছুটা এক্সপেরিমেন্ট হলেও সত্যজিতের ফেলুদা রয়েছে আমাদের হৃদয়জুড়ে; সেখানে পৌঁছবে কার সাধ্য। তাঁর সৃষ্টির কি বাহার; তাঁর সৃষ্ট চরিত্রদের ঝুলিতে আছে ভারতরত্ন থেকে অস্কার, একাধিক দেশি বিদেশী পুরস্কারের সারি। কখনো তিনি চিত্রপরিচালক, আবার কখনো সংগীতজ্ঞ, তাঁর অবদানে অনুপ্রাণিত আপামোর ভারতবাসী। বাঙালিকে দেওয়া ভূতের রাজার সেই একটাই বর হলো সত্যজিৎ রায়। তাই আজকের রোদনভরা নববর্ষে থেমে থাকা স্যাঁতস্যাতে জীবনেও বাঙালির আবেগ জুড়ে শুধুই সত্যজিৎ রায়, যার জন্মশতবার্ষিকী তে সবাই একসুরে গেয়ে ওঠে “মহারাজা তোমারে সেলাম।”