পারুল খাতুন। মুর্শিদাবাদ জেলায় থাকে। মুসলিম জনপদে দুর্গাপুজো বিষয়ে জানতে চেয়েছিলাম। পারুলের মায়ের নাম ছিল বকুল রায়চৌধুরী। সামশেরগঞ্জে বকুল রায় চৌধুরীর বাপের বাড়ি। পারুলের ঠাকুরদার নাম দশরথ রায় চৌধুরী। বকুলদের বাড়ি দুর্গা দালান ছিল। দুর্গা পুজো হতো। সামশেরগঞ্জের এক মাস্টার মশাই ধর্মে মুসলিম, তার সঙ্গে পারুলের মা বকুলের প্রেম হয়েছিল। তখন সেই সময়ের দিনকাল! বকুল পালিয়ে গিয়ে সব রীতিনীতি ভেঙে পারভেজ ইসলামকে বিয়ে করে। বকুলকে তার বাবা আর ঘরে তোলেনি। বিয়ের আগে বকুল দুর্গা দালানের গিরিবালার পুজোয় পুরোহিতের সহযোগী ছিল। সে ফলমূল কাটতো, ভোগ সাজাতো। পুজোর সময় পুরোহিতের হাত-জোগাড়ে হিসেবে প্রদীপ, ধূপদানি তুলে দিত, মঙ্গল শখ বাজাতো। সেইসব অনেক গল্প বকুল তার মেয়ে পারুল খাতুনকে বলেছিল।

আমার মা এবং দুর্গা
পারুল খাতুন

…. তারপর তো মা পালিয়ে গেল বাবার সঙ্গে কিন্তু নিজেদের মণ্ডপে দুর্গা পূজার কথা তার স্মৃতিতে রয়ে গেল। মা আমাকে বাপের বাড়ির দুর্গা কাহিনী শুনিয়েছিল। বলেছিল,ঠিক এইভাবে….
দুর্গা মেয়েদের নাম। হিমালয়ের কন্যা। কৈলাস পর্বতে তার শ্বশুরবাড়ি। শিবের সঙ্গে তার বিয়ে হয়েছিল। আগেভাগে প্রেম ছিল কিনা জানিনা। তবে বোধ করি ছিল। না হলে ছাইভস্মমাখা গাঁজাখোরকে কোন মেয়ে বিয়ে করে নাকি! দুর্গার পতির অন্য নাম নীলকণ্ঠ। প্রেমিকার স্তনযুগলের অমৃত পান করে বেঁচে গিয়েছিল। সেটা কোনো পর্নোগ্রাফি বা নিষিদ্ধ বইতে নয় আমাদের তথাকথিত ধর্মপুস্তকেই লেখা আছে।
এর থেকে বোঝা যায় যে প্রেম গভীর থেকে গভীরতর, গভীরতর থেকে গভীরতম না হলে এভাবে প্রেমিকার স্তন পান করা যায় না।।
দক্ষ রাজার মেয়ে বলে জানি দুর্গাকে। দুর্গাকে বলা হয় সতী। প্রেম কত গভীর হলে পতি নিন্দা শুনে কোনো মেয়ে দেহত্যাগ করতে পারে ভাবা যায়! আর পতি প্রিয়তমা পত্নী সতীর দেহ কাঁধে নিয়ে তাণ্ডব নৃত্য করে দক্ষযজ্ঞ বাঁধিয়ে দেয়। মানে দক্ষ শিবের সঙ্গে দুর্গার বিয়ে দিতে রাজি ছিলেন না। পিরিতি কিসের আঠা কে জানে? কি অপূর্ব প্রেম দিলে বিধাতা আমায়, মনে হয় এমন বাক্যবন্ধেই মান্না দে কোনো গান গিয়েছিলেন!

আমার মা সব জানে। মা বলেছিল, নবম বর্ষে মেয়েদের বিয়েকে গৌরীদান বলে। গৌরীদানের গৌরী মানেও দুর্গা মা-ই আমাকে এসব বলেছিল। কি করে শিব নিজের পত্নী দুর্গার স্তন্যপান করেছিল, এটা বোঝাতে মা আমাকে বলেছিল, আরে দুর্গা তো তখন আর শিবের পত্নী ছিল না, সার্বজনীন জননী মা হয়ে গিয়েছিল।

বিজয়ার পর আমার মা বাবার কাছে চিঠি লিখতো।
আমার বাবা কলকাতার উপকন্ঠে এক স্কুলে পড়াতো। সেখানে হিন্দু মুসলমান দুধরনেরই ছাত্র-ছাত্রী ছিল।কিন্তু আমার বাবার ধর্মীয় উন্নাসিকতা ছিল না। যদি থাকতো তবে কি আমাকে বিয়ে করে?
মা চিঠিতে পোস্টকার্ডে সবার উপরে লিখতো শ্রী শ্রী দুর্গা সহায়। মাকে জিজ্ঞেস করি, দুর্গা কি পুরুষ তবে শ্রী শ্রী লেখ কেন? মা বলতো, ওটা পুরুষের স্ত্রী নয়, শ্রীশ্রী মানে ব্যাপক সৌন্দর্যময়তা। ব্যাপক শব্দটা আমি লিখলুম। আমার মা এই বিষয়টা ঠিক ভাষায় বোঝাতে পারছিল না।
মা বলেছিল, দুর্গা দুর্গতিনাশিনী অসুরদলনী, মেয়েদের মর্যাদা রক্ষা করে।
সব মেয়েই দুর্গা।

মা নেই। ঘুমের গভীরে মাকে দেখি। বলি, মা তুমি মিথ্যে কথা বলে গিয়েছো। কামদুনিতে জ্যোতি নামের মেয়েটা তো জ্যোতির্ময়ী মানে দুর্গাই ছিল। জানো তাকে গণধর্ষণ করে মেরে ফেলা হয়েছে। তার যোনি প্রদেশ থেকে নাভিমূল পর্যন্ত চিরে ফেলা হয়েছিল। দিল্লিতে নির্ভয়াকে তিনজন মিলে ধর্ষণ করেছে সে মরে গিয়েছে, হাথরসে মনীষাকে পুড়িয়ে মেরেছে। দুর্গাই তো মনীষা! জানো আমাদের পাড়ার উমা পার্বতীরা সোনাগাছিতে চলে গিয়েছে। সবরমতী তীরে বিলকিস বেগমকে ১১ জন মিলে পরপর ধর্ষণ করলেও সে বেঁচে আছে। হাঁসখালির মেয়েটাও বেঁচে নেই। বগটুই কাণ্ডে জইঘরে সাতজন মুসলিম যুবতীকে মারা হয়েছে। অনেক উমা অন্নপূর্ণা পাচার হয়ে গিয়েছে। সরস্বতীরা সামসের গঞ্জের
অনেক স্কুল থেকে ড্রপ আউট হয়ে গিয়েছে, লক্ষ্মীরা এখন লক্ষ্মীর ভাণ্ডারে লাইন দেয়।

তুমি বলেছিলে দুর্গার ধর্ম বিভেদ নেই। জানো সাহিদার তালাক হয়ে গিয়েছে। জাহানারা হিজাব না পরায় তার চুল কেটে দেয়া হয়েছে। সুলতানার পাঁচ সতীনের ঘর। হাসিনার মুখে হাসি নেই।
ইতিমধ্যে দশটা বাচ্চা পয়দা করতে হয়েছে তাকে। সারাদিন বোরখায় শরীর ঢেকে রাখে লুৎফা আমিনা পারভিনরা। ঘেমে নেয়ে একসা হয়ে যায়। মা শোনো, নারী সুরক্ষা বিল পাস হয়েছে। তবে দুর্গাদের বলাৎকার করা যাবে না, পুড়িয়ে মারা হবে না, হিজাব বা বোরখায আর নিজেদের সর্বাঙ্গ ঢেকে রাখতে হবে না, তাতে এমন কোনো কথা লেখা নেই।

আর উঁচু জাতের মানুষ বলে যারা বড়াই করে তারা কিন্তু বিধর্মী দলিত সংখ্যালঘু যেকোনো দুর্গাকে ধর্ষণ করতে পারে। সে বেলা কোনো ছোঁয়াছুঁয়ি বা অস্পৃশ্যতার বালাই নেই। দুর্গাদের ভোগে উপভোগে আপত্তি থাকতে নেই!!

অনুলেখকঃ তমাল সাহা