অবতক খবর,৪ জলাই: “অকুল গাঙে ভাসলাম আমি, কুলের আশা ছাড়ি ”
জীবনপুরের পথিক তরুণ মজুমদার প্রয়াত হলেন।তিনি বাংলাদেশের বগুড়ায় জন্মেছিলেন ১৯৩১ সালের ৮ ডিসেম্বর। শচীন মুখার্জী আর দিলীপ মুখার্জীর সঙ্গে মিলে যাত্রিকের ব্যানারে “উত্তম সুচিত্রা”জুটির চাওয়া পাওয়া দিয়ে ১৯৫৯ সালে চিত্র পরিচালক জীবনের শুরু। তারপরে খালি ইতিহাস গড়ে গিয়েছেন তিনি একের পর এক ভিন্ন স্বাদের সিনেমা উপহার দিয়ে। পলাতক, আলোর পিপাসা,ফুলেশ্বরী, গণদেবতা,কুহেলি,দাদার কীর্তি ভালোবাসা ভালোবাসা, পথভোলা, অমর গীতি, আলো, ভালোবাসার বাড়ি, এবং আরও অসংখ্য ছবি ।
ছয় দশক ধরে চিত্র পরিচালনায় তরুণ মজুমদার তাঁর পথ চলার ফাঁকে বাংলা সিনেমার দর্শকদের উজাড় করে দিয়েছেন তিনি।অবিশ্রাম তিনি যুগিয়ে গিয়েছেন রুচিশীল দর্শকদের রসদ। ফুসফুসে সংক্রমণ হয়েছিল তাঁর। কয়েকদিন ধরেই ভুগছিলেন তিনি। এবার তাঁর বিশ্রাম, ৯১ বছরের পথ চলার অবসান। ঘুমিয়ে পড়েছেন তরুণ মজুমদার।
তিনি কাজেই বিশ্বাস রাখতেন। আত্মপ্রচার বরাবরই অপছন্দ করে এসেছেন তিনি।তিনি বলতেন “প্রচারের জোরে অনেকের ভাল হয় ঠিকই। কিন্তু প্রচারের পিছনে না ছুটেও দর্শকের মনে বেঁচে থাকতে পারি কি না, আমি এই পরীক্ষাটা করে যেতে চাই।” এই পরীক্ষায় সসম্মানে উত্তীর্ণ তিনি। তাই তিনি বলতে পেরেছেন, “বড়-বড় দাবি আমি করি না। খুব সাধারণ ভাবে ছবি তৈরির চেষ্টা করেছি। আর দর্শক আমাকে সমর্থন করেছেন।”
তরুণ মজুমদার চিরায়ত সাহিত্য বর্ণময় করে তুলছেন,বর্ণময় জীবন কে চিরায়ত করেছেন। মনোজ বসুর রচনা ‘আংটি চাটুজ্জের ভাই ‘ অবলম্বনে পলাতক (১৯৬৩) তাঁর অমর সৃষ্টি। পলাতকের হিন্দি রূপায়নে চলচ্চিত্র নির্মাণ তিনি করেছেন। বিভূতিভূষণের লেখা ‘কিন্নর দল’ অবলম্বনে আলো অথবা তারাশঙ্করের ‘ গণদেবতা’ বা শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়ের লেখা ‘দাদার কীর্তি ‘অথবা বিমল করের ‘বালিকা বধূ’ চিত্রে রূপায়ণ করার কারিগর তিনি। অন্যদিকে কবিগানের জন্য ফুলেশ্বরী বা নিধুবাবুর টপ্পার আলেখ্য “অমর গীতি ‘ তাঁর সৃষ্টি।সম্পূর্ণ ভিন্ন স্বাদের থ্রিলারধর্মী কুহেলি বা কিশোর গাঁথা শ্রীমান পৃথ্বীরাজ ও তাঁর সৃষ্টি। ভালোবাসা ভালোবাসার মত বক্স অফিসে তুমুল আলোড়ন ফেলা চলচ্চিত্র নির্মাণও তরুণ মজুমদারের।
বহু নায়ক নায়িকার চিত্র জগতে পদার্পন তাঁর চলচ্চিত্রের মাধ্যমে হয়েছে। তরুণ মজুমদারের সিনেমায় হাতেখড়ি হওয়া নায়ক নায়িকাদের অনেকেই ভারত খ্যাত হয়েছেন ।এঁদের মধ্যে মৌসুমী চ্যাটার্জী, দেবশ্রী রায় সহ একাধিক নাম রয়েছে। আরেকটি বিষয় উল্লেখযোগ্য তাঁর সিনেমায় ছিল রবীন্দ্রসঙ্গীতের সফল প্রয়োগ। তাঁর বেশ কিছু সিনেমায় প্রায় সব গান ছিল কবিগুরুর রচনা। দ্বিজেন্দ্রলালের গান , নজরুল গীতি কেও তিনি ব্যবহার করেছেন। আলোর পিপাসা সিনেমায় গানের ধারা ছিল রাগপ্রধান।
যাত্রা শেষ হল কিংবদন্তী চিত্র পরিচালকের। বলাইবাহুল্য তিনি দর্শকের কাছে রয়ে যাবেন অমর হয়েই, বাঙালির কাছের মানুষ হয়ে থাকবেন শাশ্বত। দর্শক জানে না ” কেন এলে, মরণের দেশে তুমি এসেছো জীবন পিছনে ফেলে ” তাঁর বিদায়ের পরে কেউ বলবে কিনা। তিনি যে কুহেলির দেশে গেলেন,সেখানে কেউ কি কুহেলির কথায় গেয়ে উঠবে? আমাদের জানা নেই। আমরা মাটিতে কান পেতে আছি, তিনি যেখানেই থাকুন, ভালো থাকুন।।