কল্যাণীর সতীমা-র মেলা— অবতক-এর বিশেষ প্রতিবেদন
সতীমা! এ যে কমন-ইজমের মেলা গো!
কাঞ্চনপল্লী নামেই ঐশ্বর্যের ঘ্রাণ। ভাগীরথীর পারে অরণ্যের ভেতর জলের বাষ্প ছোঁয়া এক বন্যতা এই গাঁয়ের শরীরে লুকিয়ে থাকে। তার ভেতর থেকে বেজে ওঠে পুরাতনী গান।
মেলা। অদ্ভুত একটি শব্দের সারল্য। উচ্চারিত হলে শুধু মানুষ আর মানুষের ঢল চোখে পড়ে।
ঘোষপাড়া। সতীমার মেলা। অলৌকিক মাহাত্ম্য থাকুক না থাকুক সে এক মানবতীর্থ। নস্টালজিয়ায় আক্রান্ত আনন্দ কানন।কর্তাভজা সম্প্রদায়ের এটি একটি প্রাণময় উৎসব।
ফাল্গুন মাস। দোলপূর্ণিমা। রঙিন উৎসব। আবিরে রাঙানো মনের উৎসবই সতীমার মেলা। সতীমার আসল নাম সরস্বতী দেবী পাল। এই ধর্মমতের প্রবর্তক হলেন আউলচাঁদ বা পূর্ণচন্দ্র। কিন্তু ঘোষপাড়ার রামশরণ পাল এই ধর্মের প্রথম প্রচারক। তার স্ত্রী সরস্বতী দেবী হলেন দ্বিতীয় প্রচারক। সরস্বতী দেবী অলৌকিক ঐশী শক্তির অধিকারী ছিলেন বলে কথিত। তাই তিনি সতীমা। এসব তো উপাখ্যান।
সাত রোজের এ মেলা। লোকসংস্কৃতির মেলা। বাঙলার শেকড় সন্ধানের মেলা। শুরু হয়েছিল ১৭৮৩ সালে। বিকিকিনির হাট বসে গো এখানে। সংসার-গেরস্তালির সব রসদ পাবে সেখানে। বাড়ির কাছে আরশিনগর! মন তুমি জানো না?
কী কী আছে? ঠাকুরবাড়ি আছে। সতীমার মন্দির আছে। সেই ঐতিহাসিক ডালিম গাছ আছে। রহস্যময় হিমসাগর আছে। ধর্মবিশ্বাসী মানুষ আছে। আর…! আর আছে নিজেকে খুঁজে ফেরার আখড়া—
ডালিম গাছে বাঁধো ঢিল,
বাঁধো মাটির ঘোড়া।
ওরে মন!মন রে!
তোর ইচ্ছে বাঁধনহারা।
আর বাউল আখড়া! সে যে হৃদয় উন্মোচনের হাট। দূর দূরান্ত থেকে জীবন ফতুর ফকির- আউল- বাউল আসে। তারা জাত মানে না। সম্প্রদায় মানে না। তারা হিন্দু জানে না। মুসলিম জানে না। তারা শুধু মানুষ জানে। তারা সৌহার্দ্যের কথা বলে। সংহতির কথা বলে। সেই যে হাঁটুর নীচ পর্যন্ত ঢিলেঢালা জোব্বা, জোড়াতালির পোশাক তারা পরে, পায়ে ঘুঙুর বাঁধে, হাতে লাউখোলার বাদ্যযন্ত্র বা গুপীযন্ত্র–তারা জীবনকে নিয়ে নাচে। তারা কমন-ইজমের গান গায়—
কার বা খাঁচা, কার বা পাখি/কারে আপন কারে বা পর দেখি/ কার জন্যে বা ঝুরে আঁখি/ পাখি আমারে মজাতে চায়।
এখানে হত ধর্মসম্মেলন। হৃদয় ব্যাপ্তির সম্মিলনী। চলতো ঋদ্ধ-হৃদ্য আলোচনা। কে না আসতেন এখানে? আসতেন মার্শম্যান, উইলিয়াম কেরী,সংযোগ রাখতেন সেই ব্যক্তিত্ব রামমোহন রায়, তারপর এসেছেন সেই ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট — “ধন্য আশা কুহকিনী”র নবীনচন্দ্র সেন। জীবন পথের মানুষ বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়।
আর কে এসেছেন বারবার? সেই যে গো! কালকূট। “কোথা পাবো তারে”, খুঁজতে খুঁজতে সে চলে গেছে ” অমৃত কুম্ভের সন্ধানে”।ঘোষপাড়ায় সতীমার মেলায় মনের মানুষ সন্ধান পেয়েছিল বলেই তো সে জীবনের সেইসব জরির কাজ,নকসি কাঁথায় সুতোর কাজ করতে পেরেছিল কলমের কালিতে ;
কে গড়েছে এমন ঘর,
ধন্য কারিগর।
ঘরের মাপ চৌদ্দ পোয়া,
চৌদ্দ ভুবন তার ভিতর।
এই তো আমাদের লোকজীবন, লোককথা, লোকগান, লোকমেলা। জীবনটারে তুই! কোথায় হেলাফেলা?
কাঁচরাপাড়া কাঞ্চনপল্লীর কল্যাণীর ঘোষপাড়া।