আজ ৩১ অক্টোবর। ইন্দিরা গান্ধীর প্রয়াণ দিবস
কাঁচরাপাড়ায় ইন্দিরা গান্ধী।
তমাল সাহা
আন্তর্জাতিক প্রেক্ষাপটে তোমাকে সকলেই চেনে। অনেকের চোখে তুমি প্রিয়দর্শিনী। রাজনৈতিক জীবনে তোমার উত্থান রীতিমতো এক সংগ্রামের ইতিহাস। তোমার পতনও এক চাঞ্চল্যকর ঘটনা।
আবার উত্থান। সে এক বিস্ময়ী দৃষ্টান্ত।
১৯৭৫ সাল ১১ জুন। বেরিয়ে গেলো এলাহাবাদ হাইকোর্টের ঐতিহাসিক রায়। রায়বরেলি কেন্দ্র থেকে সাংসদ হিসাবে তোমার নির্বাচন বাতিল আর নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করবার অধিকার ছ বছরের জন্য খারিজ।
কিন্তু তুমি মানলে না সেই নির্দেশ। ব্যাঙ্ক জাতীয়করণের মধ্য দিয়ে তুমি আলোড়ন তুলেছিলে। কিন্তু কালক্রমে ১৯৭৫ সালের ২৬ জুন স্বনামধন্য সিদ্ধার্থশঙ্কর রায়ের শলাপরামর্শে জরুরি অবস্থা জারি তোমার মুখাবয়বে কালিমা লেপন করেছিল।
জয়প্রকাশ নারায়ণকে গ্রেপ্তার ও অন্যান্য রাজনৈতিক নেতাদের জেলবন্দিকরণে তুমি হাত পাকিয়েছিলে।
তারপর ১৯৭৭। রাজনারায়ণের কাছে ৫৫০০০ ভোটে হেরেছিলে তুমি।
তুমি তো তিহার জেলেও বন্দি ছিলে। ১৯৭৮ সালের ১ জানুয়ারি তোমার নামে গড়ে উঠেছিল কংগ্রেস আই দল– ইন্দিরা কংগ্রেস। তোমার স্তাবকতা করে তোমার নামে জয়ধ্বনি উঠেছিল– INDIRA IS INDIA, INDIA IS INDIRA।
ভিন্দ্রানওয়ালেকে গড়েছিলে তুমি। তারপর এলো ১৯৮৪ র ৬ই জুন। ব্লু স্টার অপারেশন। আর তারপর ঘটে গেলো সেই হৃদয় বিদারক স্মরণীয় ঘটনা। ৩১ শে অক্টোবর তোমার মৃত্যু হলো তোমার নিজেরই রক্ষীর হাতে। তুমি গুলিবিদ্ধ হলে। ঝাঁঝরা হয়ে গেলো তোমার বুক।
বাংলাদেশের মুক্তি সংগ্রামে তোমার অনন্য ভূমিকায় উত্তুরে বাতাস লাগানো মানুষজনও আশ্চর্য হয়ে গিয়েছিল এবং রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে ভি ভি গিরিকে জয়ী করবার রণনীতি ও কূটকৌশলের কাছে নিশ্চিত হার মেনেছিল বামপন্থী বলে ঘোষক রাজনীতিবিদরা।
তুমি অদ্ভুত রাজনৈতিক চালাকি ও অবশ্যই ব্যক্তিত্বে আত্মপ্রতিষ্ঠার কারণে ভিভি গিরিকে সমর্থনের জন্য বামপন্থীদের দায়বদ্ধতার মধ্যে ফেলে দিয়েছিলে।
১৯৬৪ সালের ১৬ ই আগস্ট অন্ধ্রপ্রদেশে এন টি রামা রাও সরকারকে বেআইনিভাবে ভেঙে দিয়ে তোমাকে আগুনে মুখ পোড়াতে হয়েছিল বিরোধীদের ডাকে সারা ভারতবর্ষ ব্যাপী আন্দোলনের কাছে। এন টি রামা রাওকে মুখ্যমন্ত্রী পদে পুনর্বহাল করায় ‘বাধ্য মেয়ে’ র ভূমিকা পালন করতে হয়েছিল তোমার মতো তেজস্বিনী নারীর।
পুরানো কাসুন্দি ঘাঁটলে জানা যায় সেই ১৯৫৯ সালের ৩১জুলাই সংবিধানের ৩৫৬ ধারা প্রয়োগ করে ভারতের প্রথম কম্যুনিস্ট পরিচালিত কেরল সরকারকে কৌশলী রাজনীতিতে ভেঙে দিয়েছিলে তুমি।
তোমার কূটনীতির প্রথম পরিচয় পেয়েছিল তখন ভারতবর্ষ। তখন তোমার বয়সই বা কত! তুমি ছিলে সারা ভারতের কংগ্রেস কমিটির সভানেত্রী।
সেই তুমি। তোমাকে পা ফেলতে হয়েছিল কাঁচরাপাড়ায় ১৯৬৯। ভারতীয় রাজনীতিতে দাপিয়ে বেড়াচ্ছো তুমি। কংগ্রেসের সাম্রাজ্য বিস্তারে আঘাত পড়তে শুরু করেছে।
পশ্চিমবঙ্গ রাজনৈতিক লড়াইয়ে তখন প্রথম সারিতে।
১৯৬৭ নির্বাচনে তখন কংগ্রেসের পতন শুরু। বাংলার যুক্তফ্রন্টকে ভাঙার চক্রান্ত এবং স্পিকার বিজয় ব্যানার্জীর ঐতিহাসিক রুলিং আজও এক রাজনৈতিক ইতিহাস। তা সত্ত্বেও ভেঙে যায় যুক্তফ্রন্ট সরকার।
১৯৬৯ এর পঞ্চম বিধানসভার মধ্যবর্তী নির্বাচন। কংগ্রেসের পা রাখার জমি শক্ত করতে তুমি এলে ভোটপ্রচারে। গরিফা ছাইগাদা ময়দানে, বীজপুর ও নৈহাটির কংগ্রেস প্রার্থীর সমর্থনে জনসভায়।
কাঁচরাপাড়ার ওয়ার্কশপ রোড, বাগমোড় হয়ে জিপি রোড ধরে ছাইগাদা ময়দানে তোমাকে যেতে হয়েছিল। এই সেই ছবি। নিতাই পালের সংগ্রহে ছিলো। চিত্রগ্রাহক ছিলেন মণীন্দ্র চৌধুরী।
সেই একই রাস্তা। ওয়ার্কশপ রোড, বর্তমানে লেনিন সরণি।এই রাস্তা ধরেই তোমার পিতা প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহেরু একদিন গিয়েছিলেন কল্যাণী কংগ্রেস অধিবেশনে। সেটা ছিল ১৯৫৪ সাল। তুমি কি এসব জানতে?
সেই কাঁচরাপাড়া দেখলো জওহরলালের প্রজন্মকে। তোমার সেই হাতজোড়া ভঙ্গি, বিস্তীর্ণ অবয়ব, চমকিলী হাসি কোনোদিন দেখেছিল কাঁচরাপাড়া!