অবতক-এর বিশেষ প্রতিবেদনঃ আজ জ্যোতি বসুর ১০৯তম জন্মদিন
৪ঠা নভেম্বর ২০০০, জ্যোতিবাবু বিদায় নিলেন বাংলার মুখ্যমন্ত্রিত্বের পদ থেকে। ৮৫৪০টি গোলাপ শোভিত মালায় ভূষিত করা হয় তাঁকে। কারণ তিনি বঙ্গভূমিতে রাজত্ব করেছেন ৮৫৪০টি দিন। তিনি নেতাজি ইন্ডোর স্টেডিয়ামে সংবর্ধনার উত্তরে বলেন,”আপনারা মানুষের প্রতীক হিসেবে আমাকে দেখেছেন তাই সংবর্ধনা দিচ্ছেন।” কিন্তু এই জ্যোতি বসু কি জ্যোতি বসু হতে পারতেন কাঁচরাপাড়া না থাকলে? জ্যোতিবসুর রাজনৈতিক উত্থান কাঁচরাপাড়ার ট্রেড ইউনিয়ন আন্দোলন সংগঠিত করার মধ্য দিয়েই। কাঁচরাপাড়ার শ্রমিক সংগঠন গড়ার কাজে কমরেড অমূল্য উকিল তাঁকে সাহায্য করেছিলেন। তা জ্যোতি বসু নিজেই স্বীকার করেছেন। তাঁর ‘যতদূর মনে পড়ে’ গ্ৰন্হে।
সিটিবাজার কারখানা গেট সংলগ্ন অঞ্চলে চোঙাফুঁকে বক্তৃতা দিয়েছেন জ্যোতি বসু। সঙ্গে রয়েছেন নিত্যানন্দ চৌধুরী, অমূল্য উকিল প্রমুখেরা। সেটা ছিল ১৯৪৪ সাল। তাঁর নেতৃত্বে এবং বঙ্কিম মুখার্জীর সভাপতিত্বে গড়ে উঠেছিল বিএন রেলওয়ে ওয়ার্কশপ ইউনিয়ন। তখন কাঁধে ব্যাগ ঝুলিয়ে আসতেন জ্যোতি বসু। থানার মোড় ভূষণ চন্দ্র দে-র মিষ্টির দোকান তখন তো টালির ঘর। সেখানে বসে মাটির ভাঁড়ে চা খেয়েছেন। কখনো থেকেছেন ধোবিপুকুর রোডে নিকুঞ্জ মিস্ত্রির বাড়ি, স্টেশন রোডে শ্রীলক্ষী সিনেমার কাছে রামকৃষ্ণ স্টোর্স-এরকাছে খড়ের চালাঘরের কমিউনে। কখনো সিদ্ধেশ্বরী লেনে শৈলেন চ্যাটার্জীর বাড়ি। রানি প্রেসের পেছনে শ্রীপদ সেনগুপ্তদের আস্তানায় বা দমকলের পাশে সেই মেসবাড়ি যেটি তখন রীতিমতো কমিউনিস্ট ঘাঁটি আর জ্যোতি বসুর সেখানে যাতায়াত ও আশ্রয় সেসব ঐতিহাসিক ঘটনা।
কাকাবাবু মুজফ্ফর আহমদ, জ্যোতিবসু, নিত্যানন্দ চৌধুরী মাটিতে বসে উবু হয়ে একসঙ্গে ভাতও খেয়েছেন সিটিবাজারে অমূল্য দাসের বাড়িতে। কখনো থেকেছেন হালিশহরের খাসবাটির মোহন মুখুজ্জের লালবাড়িতে। সতীশ নন্দী বাইলেনের এম এল সি কোয়ার্টারে — ‘স্বাধীনতা’র ফেরিওয়ালা যতীন ভট্টাচার্য্যের বাড়িতেও জ্যোতিবাবুর ছিল আনাগোনা। আর সেই সময় এই বাড়িতেই থাকত পার্টি অফিস খোলার চাবিটি। বঙ্কিম মুখার্জীর মত তাত্ত্বিক নেতা ছিলেন সেখানে।
আত্মগোপনের কাল। একমুখ দাড়ি নিয়ে জ্যোতি বসু এসেছেন কাঁচরাপাড়ায়। ব্যান হয়ে গেছে কমিউনিস্ট পার্টি ১৯৪৮। রাত কাটিয়েছেন এই ওয়ার্কশপ রোডের পার্টি অফিসের বেঞ্চিতে শুয়ে।
তিনি যখন কাঁচরাপাড়ায় এসেছেন তখন তাঁর সঙ্গে এসেছেন কামগার নেতা মহম্মদ ইসমাইল, তাত্ত্বিক নেতা ভবানী সেন। কখনো ডাকসাইটে ইন্দ্রজিৎ গুপ্ত, বিপ্লবী নিরঞ্জন সেন, কখনও শ্রমিক নেতা নীরেন ঘোষ বা গোপাল বসু। সঙ্গে থেকেছেন এখানকার সুকুর সাহেব,কুঞ্জ বসু,ননী সেন, যতীন ভট্টাচার্য্য,অময় অধিকারী, ইন্দ্রজিৎ মল্লিক এমন আরও কত কে!
তিনি আত্মগোপন করার জন্য উঠেছেন দমকল এলাকার মেসবাড়িতে। সেখানে তাঁর জন্য খাবার নিয়ে গেছেন রজনীবাবু রোডের জেলখাটা কমিউনিস্ট সদস্য বিভূতি চ্যাটার্জী।
বরানগরে জ্যোতি বসুর নির্বাচনের কাজে সহযোগিতার জন্য কাঁচরাপাড়া থেকে ছুটে গিয়েছেন মহিলা আত্মরক্ষা সমিতির সদস্যা সবিতা চ্যাটার্জী,বিমলা সেনগুপ্ত, সতীশ নন্দী বাইলেনের বিল্ব ভট্টাচার্য্য। সেই সময় জ্যোতিবাবুর গাড়ির ড্রাইভার ছিলেন কাঁচরাপাড়ার রবি চক্রবর্তী।
জ্যোতি বসু তিনবার রাজনৈতিক বক্তৃতা দিয়ে গেছেন কাঁচরাপাড়ার কবরখানা ময়দানে। ১৯৬২-তে চীন-ভারতের যুদ্ধের সময়,৬৯-এর শাসনকালে এবং ৭৭-এর প্রাক নির্বাচনের সময়।
১৯৪৬ সাল আইনসভা নির্বাচনে জ্যোতিবসু দাঁড়ালেন রেলওয়ে কেন্দ্রের প্রার্থী হিসেবে।সেবারের নির্বাচনে জ্যোতি বসুকে লড়তে হয়েছিল জবরদস্ত প্রার্থী রেলওয়ে এমপ্লয়িজ অ্যাসোসিয়েশনের প্রেসিডেন্ট শিক্ষাজীবী হুমায়ুন কবীরের বিরুদ্ধে। এই নির্বাচনে কাঁচরাপাড়ার রেল কামগারেরা ব্যাপকহারে ভোট দিয়ে জ্যোতি বসুকে আইনসভায় যাওয়ার পথ সুগম করে দিয়েছিল।
২২শে এপ্রিল ২০০১ কল্যাণী-ব্যারাকপুর হাইওয়ে সংলগ্ন জোনপুরে অবস্থিত কাঁচরাপাড়া পৌরসভার মাঠে জ্যোতি বসু বিধানসভা নির্বাচনে বীজপুর, নৈহাটি ও চাকদহ বিধানসভার তিন প্রার্থী জগদীশ চন্দ্র দাস, রঞ্জিত কুন্ডু এবং সত্যসাধন চক্রবর্তীর সমর্থনে শেষ বক্তৃতা দিয়ে যান।
বক্তৃতায় তিনি কংগ্রেসকে ‘ভিখিরি’ এবং বিজেপিকে ‘বর্বর’ বলে উল্লেখ করেন। ৭৭ সালের প্রাক নির্বাচনী সভায় কংগ্ৰেসী সন্ত্রাসের বিবরণ দিয়ে জ্যোতি বসু বলেছিলেন,’ওরা আমাদের ছেলেদের ধরে ধরে বলছে,বল বন্দেমাতরম্। আমি বলি বন্দেমাতরম্ বলতে আপত্তি কি? মাকে বন্দনা করব না তো কাকে বন্দনা করব? দেশমাতাকে বন্দনা করতেই তো আমরা কমিউনিস্ট।’
এই পড়ন্ত বেলায় এই সংকট মুহূর্তে তোমার রাজনৈতিক জীবনের উত্থানের উৎসস্হল কাঁচরাপাড়াকে কি তোমার মনে পড়ে জ্যোতি বসু?