অবতক খবর,৩মে: ভাগীরথীর উপকূলে ঘনতম অন্ধকার নেমে আসার আগে কয়েকটি কণ্ঠস্বর প্রক্ষেপণ করে রাত্রির জাহাজ ছেড়ে দিয়েছিল সে। তখন সে জানতো এ প্রস্তুতি মাত্র। রাত্রি এরপর পরে নেবে বারুদ-গন্ধ পোশাক। দৌড়ে যাবে গাঙ্গেয় উপত্যকায় অন্য এক জান্তব হিংস্রতায়। ‘উৎকণ্ঠ শর্বরী’র অন্তিম পর্যায়ে লক্ষ্যভেদী তীরন্দাজের মত তূণীর থেকে ১১টি কাব্যিক শব্দবাণ নিক্ষেপ করে সে জানিয়ে দিয়েছিল কবিতা শুধুমাত্র বাক্যবন্ধ নয়, সে সশব্দে কথা বলে যাবে মানুষের কাছে পৌরুষেয় অনুভবে। প্রথমেই সে বলেছিল— কয়েকটি উজ্জ্বল মুখ পরস্পরকে ডেকে বলি, শোনো—/ আমরা মৃত্যুর কথা বলি না কখনো।
কাব্যরীতিকে ভাঙচুর করে সে ঘোষণা করল— অনেক ফুল তো ফোটানো হলো এই বাগানে—/ এবার কিছু ভুল করো/ ছন্দ ভুল, অর্থ ভুল।
এইভাবে অনিবার্য নিয়মে রাত্রি নেমে আসে গাঙ্গেয় গান্ধীনগরে ৭০ দশকে। সেও সেই দশকে শব্দের দুর্জয় মশাল জ্বেলে গান্ধীনগরের কবি হয়ে গেল। ৩৯টি কবিতা নিয়ে তা বিস্ফোরণ ঘটালো ভারতীয় কবিতার বিশাল প্রান্তরে। ব্যবহারিক ভাষায় সাবলীল বিচরণ, পুরাণ ইতিহাসের প্রায়োগিক নৈপুণ্য, শাব্দিক তেরিয়া মেজাজে সে হয়ে উঠল সম্পূর্ণ ব্যতিক্রমী কবি।
৬০-এর দশকের কবিতার সমস্ত নষ্টামি উলোট-পালোট করে সে বেরিয়ে এল এক বিস্ময়ী চিত্রকল্প নির্মাণ করে— পুজোর আগে যারা ভুল করে বা ইচ্ছে করে কুল খেয়েছিল এবং খায়নি/
দু’দলেরই চোখাচোখি হবে এমপ্লয়মেন্ট এক্সচেঞ্জের বেইজ্জত বারান্দায়।
৭০ দশকে সে লিখে ফেলল নিজস্ব সংলাপ— মাটির বুক চিরে খনিজ ও ইস্পাত /জড়ো হচ্ছে বন্দুকের নলের তলায়, কাশীপুর বরানগরের/ সমস্ত লাশ ঠেলাগাড়িতে করে চালান হয়ে গেছে গঙ্গায়। আর কি লিখল?
আলকাতরা ও বাঁশের নৈশ সংঘর্ষে /যখন দেয়ালে ফুটে ওঠে, ‘বন্দুকের নলই ক্ষমতার উৎস’ তখন /ক্ষমতার আগে ‘রাজনৈতিক’ শব্দটা নেই বলে আমি আঁতকে উঠি।
তাঁর উজ্জ্বলতম পংক্তি—
শবচক্র,মহাবেলা প্রশস্ত প্রাঙ্গণ/পাথরে পাথরে গর্জে কলোনির শুভদ্রার শোক।
আমাদের আত্মশ্লাঘা রয়েছে তার জন্য। কেননা এই জনপদের নাগরিক জীবনে সে ছিল সম্পৃক্ত। ৬০-এর দশকের উত্তাল পর্বে যখন ঘটে চলেছে ভিয়েতনাম, সেই সময় ১৯৬২-তে সে হার্ণেট হাই স্কুলে প্রবেশ করেছিল শিক্ষক হিসেবে। দারিদ্রলাঞ্ছিত ষ মুহূর্তে কাঁচরাপাড়ায তার মুখে তুলে দিয়েছিল দু’মুঠো ভাত। সে নিয়মিত লিখেছে কাঁচরাপাড়ার অতন্দ্র, এইদিন, সাহিত্য পত্রিকায়। আর যে কাব্যগ্রন্থ প্রকাশের পর সে কবি হিসেবে বিতর্কিত অথবা সমাদৃত হয়ে পড়ল সেই ‘গান্ধীনগরে রাত্রি’ প্রকাশের অন্তরালে রয়েছে কাঁচরাপাড়ার অনিবার্য ভূমিকা। সে নিজেও কাব্যগ্রন্থের মুখপাতে বিনম্র অনুভাবে স্বীকার করে নিয়েছে এই অঞ্চলে সতীর্থ বন্ধু ও ছাত্রদের অনুরোধের দৌরাত্ম্য এবং আর্থিক আনুকূল্যের কথা। বিশেষ করে ছাত্র দেবকুমার বন্দ্যোপাধ্যায় ও বন্ধুবর রঞ্জিত দস্তিদারের সহযোগিতা।
২০০৮ সালে ‘শ্রেষ্ঠ কবিতা সমগ্র’-এর জন্য রবীন্দ্র পুরস্কার অর্জনের পর তাঁকে কাঁচরাপাড়া পৌরসভা নাগরিক সংবর্ধনা দিয়েছিল ৩১ মে,২০০৮, শনিবার। কবরখানা ময়দান সংলগ্ন এল ই ডি বিল্ডিংয়ে হয়েছিল সেই অনুষ্ঠান। এদিন কবিকে উত্তরীয় পরিয়ে দেন পৌর পার্ষদ পুতুল সরকার, পুষ্প স্তবক তুলে দেন প্রবীণ কংগ্রেস নেতা নরেন দে,পাজামা-পাঞ্জাবি পরিধেয় তুলে দেন বিধায়ক নির্ঝরিণী চক্রবর্তী এবং মানপত্র তুলে দেন প্রাক্তন বিধায়ক জননেতা জগদীশ চন্দ্র দাশ। পৌরসভা ও পৌর কর্মচারী সমিতি এবং সিপিএম উত্তর লোকাল কমিটির পক্ষে পুষ্পস্তবক দিয়ে কবিকে সংবর্ধিত করেন যথাক্রমে পৌরপ্রধান শঙ্করলাল বসাক, অঞ্জন বোস এবং শম্ভু চ্যাটার্জি। এইদিন পত্রিকার পক্ষে পুষ্প স্তবক দিয়ে সংবর্ধনা প্রদান করেন পত্রিকা সম্পাদক সুকান্ত চট্টোপাধ্যায়। কবির হাতে মিষ্টির প্যাকেট তুলে দেন সাহিত্যিক জগদীশ মোদক।কবির পরিচিতি বিষয়ক ফোল্ডার পাঠ করেন তমাল সাহা। কবি ও তাঁর কবিতা বিষয়ক বক্তব্য রাখেন ড. বাঁধন সেনগুপ্ত।
উদ্বোধনী সঙ্গীত পরিবেশন করেন পৃথ্বী বসু।কবিতা পাঠ করেন উপৌরপ্রধান অসীম কুমার ভট্টাচার্য। অনুষ্ঠান সঞ্চালনায় ছিলেন পৌর তত্ত্বাবধায়ক দেবাশিস রায়।
পরবর্তীতে কল্যাণী পৌরসভা কর্তৃকও সংবর্ধিত হয়েছিলেন কবি।
সে দেখতে পেয়েছিল সেই অপ্রতিহত আকাঙ্ক্ষাময় অনাগত আগামীকে— একদল শক্ত মানুষ এই প্রবল রাত্রিতে একটি বিশাল সারবান/ তেজি দীর্ঘায়ু বৃক্ষের মতো/ ভোরের দিকে টেনে নিয়ে যায়, আমি /স্বপ্ন ও তন্দ্রার মধ্যবর্তী অঞ্চলে সমস্ত আকাশে তারার আগুন /সমস্ত সমুদ্রে হাজার হাজার জাহাজ ছড়িয়ে দিয়ে/ মানুষ, কেবল সীমাহীন মানুষের শব্দ শুনতে পাই।