আমি তো জল ভালোবাসি। গঙ্গা তো জলকন্যা। তার বুকের অতলে ডুব দিয়ে আমি মরতে চাই।
কাল গঙ্গাপুজো। আজ তাই জল লিখি..

গঙ্গাবতীর পায়ের কাছে
তমাল সাহা

রৌদ্রের আগ্নেয় প্রবাহ মাথায় করে কার কাছে যাবে তুমি? কার কাছে যেতে পারো, সে তো নারীর কাছেই।এখন তোমার জরুরি প্রয়োজন, শুদ্ধস্নানের আয়োজন। কে শীতল করতে পারে তোমার এই দেহতনুমন?

এই নিদাঘে খরদাবদাহে কোনো জলনারী ডাকবে তোমায়, কাছে এসো! তুমি তো এই প্রতীক্ষাতেই আছো।!
তুমি আজীবন জলের কাছেই ছুটে গিয়েছো। দেখেছো বিস্তীর্ণ জলধারা কোলে নিয়ে বসে আছে বেগবতী জলকন্যা।

তুমি চৈতন্যডোবা ঘাটে গিয়ে কোনো প্রজন্ম তার পিতার উদ্দেশ্যে বার্ষিক শ্রদ্ধায়নের কর্মকাণ্ড নিয়ে ব্যস্ত সে দিকে একবার চোখ ফিরিয়ে এখন তাকিয়ে আছো বিস্তীর্ণ সলিলার অভিমুখে। দেখছো নদীর মাঝখানে শস্যবতী চরভূমি। নারীপুরুষের শ্রমের সম্মিলন মিশে যাচ্ছে মাটির সাথে চাষভূমে।

কত জলঘাটের স্মৃতির সঞ্চয় আছে তোমার। জল পারে আদিবাসীর রমণীরা পাললিক মাটি ছেনে কিভাবে ইট বানায়, নটবর ঘাটের জলস্রোতে লেখা আছে শোক বিষাদ বিরহের কথা। পেছনে জ্বলছে আগ্নেয় কাঠ। তুমি দেখো জলস্রোতে ভেসে যায় ছোট্ট মালসায় কার নাভিকুণ্ডল, বিসর্জনের রজনীগন্ধা-গাঁদা ফুলের মালা। জলের বিস্তৃত বক্ষ তোমার নজর কেড়ে নেয়।

ডুব দে মন জয় কালী বলে! সে-ও তো জলে ডুব।জল ছাড়া মুক্তি কোথায়? তুমিও তো দেখি ব্রহ্মময়ী শঙ্করী বলে উচ্চারণ ছুঁড়ে দাও জলের দিকে রামপ্রসাদ ঘাটে!
কারা স্নান সেরে সিক্ত বসনে উঠে আসে? সে তো তোমার প্রিয়তমা নারীরা!ভেজা বস্ত্রের উপর দীর্ঘ গামছা জড়িয়ে মন্দিরে আসে। হাত উঁচু করে ঝুলন্ত ঘন্টায় ধ্বনি তোলে। তুমি ঘাটে বসে থাকো।জলপ্রবাহ তোমার পদতল ছুঁয়ে যায়, ঘন্টাধ্বনির অনুরণনের আবহে তুমি স্রোতস্বিনীকে দেখো। তুমি তো তার বুকের অনন্ত অতলে হৃদয় খুঁজে পেতে চাও।

জল! জল! জল! সিদ্ধেশ্বরী ঘাটে বটের ছায়ায় বসে থাকো তুমি। ওই দূরে শ্যামাসুন্দরীতলা। সান্ধ্য নক্ষত্রের সমাবেশ। জলে নৌকার ছায়া ফেলে কারা চলে যায়! জোনাকির মত বিন্দু বিন্দু আলো জলের ভেতর ফুটে ওঠে।

রামঘাট দাহঘাট। প্রতিদিনই স্বজন আত্মীয়ের চিতা জ্বলে ওঠে। সম্মিলিত হরিধ্বনি ওঠে। ধ্বনিরব এড়িয়ে গিয়ে তুমি গাঙ্গেয় জলের পাশে বসে থাকো।
ভাঙ্গা বাঁধ ঘাটে এত ঘনঘন যাও কেন তুমি? তোমার খেয়া খানি বাঁধা আছে নাকি সেখানে!

আজ গঙ্গাপুজো। শুক্লা শব্দটি ভীষণ পছন্দ তোমার। শুক্লা দশমী জ্যৈষ্ঠ মাস। দশহরা। তোমার পিতা তোমাকে শিখিয়েছিল যে নারী দশটি পাপ হরণ করে সেই দশহরা। কি সেই পাপ? কাম ক্রোধ লোভ মোহ মাৎসর্য হিংসা হত্যা ছলনা জালিয়াতি পরনিন্দা। আমিও তো পাপী। তোমার তো মন্ত্রজ্ঞান নেই, নেই পূজার্ঘ্য দশটি ফুল ফল প্রদীপশিখার ঔজ্জ্বল্য। কিভাবে করো তুমি তবে গঙ্গা পূজা?

এটা কোন পূজা পদ্ধতি? তুমি তরঙ্গিনী গঙ্গাকে জিজ্ঞেস করো, হে জল নারী তোমার গর্ভে এত জল কেন? পাপে পূর্ণ মানুষেরা তোমার দেহে ডুব দিয়ে নিজেদের পাপস্খলন করে যায়‌। তুমি তো আরো পাপপূর্ণ হয়ে ওঠো!
স্রোতবতী নারীটি তোমাকে বলে, মন্ত্র পূজার্ঘ্যের প্রয়োজন নেই। পৃথিবীর ভালোমানুষেরাও তো অবগাহনে আসে। তাদের শুদ্ধস্নানে আমি পুণ্যবতী হয়ে উঠি।
হে জলনারী তোমার বক্ষ সলিলে দশটি পাপ মাথায় নিয়ে এই তিন, এই পাঁচ, এই হল সাত, এই মোট বারোটি ডুব দিলাম। আমাকে গ্রহণ করো, আমাকে পাপ থেকে মুক্ত করো,হে নারী!

ওঁ গঙ্গে চ যমুনে চৈব গোদাবরী সরস্বতী।
নর্মদে সিন্ধু কাবেরী জলেহস্নিন সন্নিধিং কুরু।।
…..
সুখদে মোক্ষদে গঙ্গে গঙ্গৈব পরমাং গতি।।