মেথরপাড়া শব্দটা প্রথম পেয়েছিলাম মনে হয় রবীন্দ্রনাথের কাছ থেকে। আমাদের এইখানে বেশ কয়েকটি মেথরপাড়া আছে। আমরা বলি মেথরপট্টি। এখন বড় হয়েছি একটু বুদ্ধিশুদ্ধি হয়েছে বোধ করি। এখন গান্ধীজিকে অনুসরণ করে বলি হরিজন পাড়া। এতেও ঝামেলায় পড়ে যাই। চন্দন চেপে ধরে। বলে, কাকু হরিজনই বা বলবে কেন? তবে কি আমরা হরিজন নই? আমরাও তো হরিজন। আমি চন্দনের দিকে তাকিয়ে থাকি্ ও তো ঠিকই বলেছে।
চন্দন বলে, এ ও কৌশল বাজি! মেথর শব্দটি পাল্টে হরিজন বললেই কি মেথর জাতে উঠে যাবে? তুমি যদি বলো হরিজন পাড়ায় চলো তাহলে তো তুমি মেথর পাড়াতেই যাবে। তুমি কি বামুনপাড়ায় যাবে নাকি? এর উত্তর দেবার ক্ষমতা আমার নেই। প্রশ্ন সহজ, উত্তর কঠিন।
১২-১৩ বছর বয়স থেকেই আমি মেথরপাড়ায় যাই। মুনিলাল বাঁশফোড়। বাবু ব্লক মেথর পাড়ায় ছিল। ইস্টার্ন রেলওয়ে ডিভিশন স্পোর্টস মিটে যে মুনিলালের পোলভল্ট দেখেনি সে কাঁচরাপাড়ার কিছুই দেখেনি। সে এই কাঁচরাপাড়া কারখানায় গ্রুপ ডি কর্মী ছিল যতদূর মনে পড়ে।
বাবু ব্লক মেথর পাড়া দিয়ে যেতে যেতে হৃষীদা মেথরদের শুয়োর মারার দৃশ্য দেখেছিল। সে লিখে ফেলল শূকর নামক গল্প আর বিখ্যাত হয়ে গেল। হৃষীকেশ মুখোপাধ্যায় সে ছিল আমার দাদা ও বন্ধু এই অঞ্চলের অধুনা সাহিত্যের কারিগর।
এখানে দীনবসু লেনের নিচের দিকে, সিদ্ধেশ্বরী লেন, ইট খোলা ষ্টোর ব্লক, ভৃতবাগান কবরস্থান অঞ্চলে মেথর পাড়া আছে। ডাঙ্গাপাড়া রেলওয়ে মেথর বস্তি তো উল্লেখযোগ্য। এখানে হরিজন স্কুল আছে, আম্বেদকরের মূর্তি আছে। হরিজন নেতাদের সঙ্গে আমার ১৯৮২ সাল থেকে দীর্ঘ পরিচয়। হরিজন সংগঠন আছে। সেখানে দু একবার ওই যে ভাষণ বলে না এমন বক্তব্য আমি রেখেছি। এখানে মহাশ্বেতা দেবী এসেছে, মদবিরোধী আন্দোলনে অংশগ্রহণ করেছে। সেই হরিজন ছেলেটা রাজেন্দ্র বাঁশফোড় খুন হয়ে গেল ডাঙ্গাপাড়ায়। স্পল্ডিং মাঠে লোহার রোলার চাপা দিয়ে তাকে মারা হয়েছিল। সে মদবিরোধী আন্দোলনে সক্রিয় অংশগ্রহণকারী নেতা ছিল। তার প্রতিবাদে শোকসভায় বক্তব্য রাখতে থানায় ডেপুটেশন দিতে মহাশ্বেতা দেবী এসেছিল। সেটা ১২ ফেব্রুয়ারি ১৯৮২।
কাঁচরাপাড়ার জন্য যুগান্তরে কলম ধরেছিল ৩০ মার্চ ১৯৮২। মহাশ্বেতা দেবী খোলা চিঠি লিখেছিল জ্যোতি বাবুর কাছে ২৮ ফেব্রুয়ারি, ১৯৮৫। প্রতিলিপিটি রাখা আছে সযত্নে।
হালিশহর ডানলপ ঘাটের মেথর বস্তি তো আমাদের নিজের। পুজোর আগে পুজোর গন্ধ পেতে প্রতিমা শিল্পী শান্তি পালের আখড়ায় আমরা প্রতিবছরই যেতাম। শান্তিদার প্রতিমা গড়ার সেই কাজ– কাঠামো বানানো, বিচুলির কঙ্কাল থেকে মূর্তি গড়া, রং করার কাজ, চক্ষুদান, গর্জন তেলের ছোঁয়া এসব দেখো আর রামপ্রসাদ ও ভনা পটোর গল্প শোনো শান্তিদার কাছ থেকে। আমার আর টুলু মানে বিশ্বজিৎ দাসের এসব দেখা অভ্যাসে দাঁড়িয়ে গিয়েছিল।
তারপর ডানলপ ঘাটের মেথর পট্টিতে ঢুকে পড়ো! একটা বিশাল বটগাছ তার নিচে খাটিয়া পাতা। কখনো সেটাতে বা কখনো মাটিতে মাদুর পেতে বসে পড়ো। নদীর জলস্রোত দেখো। মরা গরু ভেসে যায়। ওপারে ডানলপের চিমনি আকাশের দিকে মাথা তুলে দাঁড়িয়ে। নীল আকাশ সাদা মেঘ উড়ে যায়।নদী চরায় কাশফুল দুলছে। ততক্ষণে ছোট ছোট কাচের গ্লাসে চলেছে রতনলালের হাতছোঁয়া চোলাইয়ে মজেছে মন। মেজাজে ধুন উঠলে– ডুব দে রে মন জয় কালী বলে– গঙ্গাস্নান।
আজ ভাতৃদ্বিতীয়ার সন্ধ্যেবেলায় ভ্যানে দুটি বস্তায় ৫০ টি লাউ নিয়ে চন্দন হাজির। চন্দন বলে, হরিজন পাড়ায় লাউ বিতরণ করবে, চলো। ছটপুজোর আয়োজন শুরু হয়ে গেছে। লাউ ভাত খেতে হয় এই পূজায, জানো তো!
আমি বলি, ধুর! ওইসব পুজোটুজোতে আমি নেই। চন্দন বলে, এ কি তোমার বাঙালির দুর্গা পুজো নাকি? তুমি দেখতে পাও না এইসব দেবদেবী। তাও ঘটা করে পূজা করো, মন্ত্র উচ্চারণ করো। কে বুঝে তোমার ওই মন্ত্র? এতো সূর্য পুজো! সূর্যকে তুমি আমি তো সারাদিন দেখি। জানো তো সূর্যই আসল শক্তি। সূর্য যেদিন থিকে উঠা বন্ধ করে দিবে সেদিন থিকে পৃথিবীর বারোটা বেজে যাবে। তুমিতো লিখাপড়া জানো। দেখবা বড় বড় কবিদের কবিতায় সূর্যের কথা লিখা আছে। আমি বলি তাই নাকি! চন্দন হিন্দিভাষী মানুষ। তাই এমন উচ্চারণে কথা বলে।
চন্দন রাস্তায় এখন কিয়স্কে রোল মোমোর বেচে। ঠেলাগাড়ি দোকানের নাম দিয়েছে হিন্দুস্থানী রোল।
ও মেথর হরিজন এমন ভাষা কখনোই বলে না, বলে সাফাই কর্মী। কত মানুষের কাছ থেকে কত কি যে শেখা যায়!
আমি চন্দনের মুখটি বারবার দেখি।
তাহলে চল্! লাউ বিলি করি। আজ ভ্রাতৃদ্বিতীয়া।
আকাশে চাঁদ খুঁজে পেলাম না। তাকিয়ে দেখি কয়েকটি নক্ষত্র ফুটে আছে। আলো ছায়া অন্ধকারে হরিজন পাড়ায় তখন আমরা, সঙ্গে লাউ আর পূজারিণী মায়েরা।
© তমাল সাহা
২৮ অক্টোবর,’২২