অবতক খবর,১৩ নভেম্বর: কলকাতার ছেলে হাওড়া জেলার জামাই, নিতত্ত্ববিদ স্বরূপ ভট্টাচার্য; বাংলার হারিয়ে যাওয়া নৌকা সংরক্ষণের জন্য তৈরি করছেন। দেখতে আসা ‘ছোট্’ নৌকার গঠন কৌশলের জন্য যা আজকে বাংলায় লুপ্ত। সংরক্ষণ করা হবে গুজরাটের সমুদ্র সম্পর্কিত ‘ন্যাশনাল মেরিটাইম মিউজিয়ামে।’ বাংলার নৌকা বাংলায় সংরক্ষিণ না হয়ে গুজরাটে কেন? এ ব্যাপারে স্বরূপ বাবু জানান, তার জন্য আমরা লিখিত আবেদন করেছিলাম এবং বারবার খোঁজও নিয়েছিলাম কিন্তু সরকারের তরফ থেকে কোন সদুত্তর আসেনি। এই নৌকা সম্পর্কিত পুরো বিষয়টি ডিজিটালাইজেশনের মাধ্যমে সংরক্ষিত থাকবে ব্রিটিশ মিউজিয়ামে।
সংগ্রাহক হিসাবে সবসময় চাই বাংলা তথা ভারতের ঐতিহ্য ও ইতিহাসকে তুলে ধরছে। ছোট্ এর বিশেষত্ব হলো সাগরের জলে ও নদীতেও নির্বিঘ্নে ভাসতে পারে। বিশেষ এই নকশার নৌকাকে জলে ডোবানো কঠিন। আগে বাংলা নদীতে এই নৌকা ব্যবহার হলেও এখন আর দেখা যায় না নদীর নব্যতার কারণে। বাংলার নিজস্ব প্রযুক্তিতে তৈরি এই নৌকা তৈরি করতে ৩০ দিন সময় লাগল। ৩৫ফুট লম্বা ও ৯ফুট চওড়া এবং প্রায় ৮ফুট গভীরতা বিশিষ্ট নৌকার ওপর দাঁড়িয়ে বোঝা গেল ইংরাজী ‘V’ আকৃতির মতো। নৌকার তলদেশে একটি চওড়া মোটা কাঠ লাগানো হয়েছে। এই কাঠকে বলা হয় ‘কিল’। কাঠামোর কাঠের পাঠাতন ভি আকৃতির জন্য ঢেউ বা বাতাসের ধাক্কাতেও স্থির থাকতে পারে।
স্বরূপ বাবু ছোট্ নৌকার পুনস্থাপনের ব্যাপারে বললেন, ” জল পথেই সভ্যতার শুরু। প্রথমে গাছের গুড়ি নদীতে ভাসিয়ে যাতায়াত। তারপর নৌকা, জাহাজ এবং সময়ের সঙ্গে জলযানের বর্তমান রূপ আমাদের সকলেরই জানা। হারিয়ে যাওয়া জলযান নিয়ে অনেকে কাজ করলেও এই প্রথম হারিয়ে যাওয়া নৌ-শিল্প তুলে ধরতে এগিয়ে এলো ব্রিটেনের একটি বিশ্ববিদ্যালয়। ব্রিটেনের এক্সটার বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক জন. পি. কুপার, জিশান আলী শেখ, হরিয়ানা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক বসন্ত সিন্ধে এই চারজনের দলই কাজটির দায়িত্বে। কুপার সাহেব কয়েকদিন আগেও কাজ দেখাশোনা করে গেছেন। আর আপনারা দেখতেই পারছেন জিশান ও আমি নৌকার কাজের তত্ত্বাবধানে আছি। এনডেঞ্জার্ড মেটেরিয়াল নলেজ প্রজেক্ট-এর তহবিল থেকে প্রকল্পের অর্থ বরাদ্দ করেছে বৃটেনের একটি সংস্থা। যদিও এরপরও কোন ব্যক্তি বা সংস্থা অর্থ সাহায্য করেন এই বিষয়ে তাহলে হারিয়ে যাওয়া বাংলার আরও কয়েকটি ডিজিটালাইজেশন করতে পারি।
৭০ ঊর্ধ্বো নৌ-শিল্পী পঞ্চানন মন্ডল জানান, নৌ-শিল্পে এখন ভাটার টান। কাজ হারিয়ে এই গ্রাম ছেড়ে ছেলেরা এখন দীঘা-র সমুদ্র অঞ্চলে কাজ করছে। সারা বছর কাজ না পেলে খাব কি? তাই অন্য কাজে চলে যাচ্ছি। তবে এত বছর পর এই কাজ করে বেশ ভালো লাগছে।
এই স্থানে নৌকা তৈরির ব্যাপারে স্বরূপ বাবু আরো জানালেন, ভৌগলিক ভাবে এই অঞ্চলটি নৌকো তৈরীর উপযুক্ত স্থান। ওপারে তমলুক বন্দর। প্রাচীন এই বন্দরের ইতিহাস সকলেরই জানা। এখানে যে গ্রামগুলি দেখছেন তার একটি জেলেপাড়া, যাদের জীবন ও জীবিকা মাছ ধরে চলে। তার পরের গ্রামটিকে মিস্ত্রিপাড়া বলা হয়। এই গ্রামে নৌকো তৈরি মিস্ত্রিরা বসবাস করেন। নৌকার উপকরণীয় কাঠ, পেরেক, কাপড় ইত্যাদি সমস্ত সামনের বাজারেই পাওয়া যায়। এরকম পরিবেশে কাজ করায় অনেক সুবিধা।
এখানে ঘুরে মাঝি-মল্লাদের সঙ্গে কথা বলে আরো কয়েকটি ছোট নৌকার নাম জানা গেল। যেমন পাটিয়া, গাউকা, বতালি, গলুয়া, মেরিলি, সুলতানা ইত্যাদি ছোট্ নৌকার কথা।
পঞ্চানন বাবু ও তার চার পুত্র অমল, মনিমোহন, দিলীপ ও দীপক ছোট্ নৌকাটিকে আস্তে আস্তে উল্টে দক্ষিণ দিকে দাঁড় করালেন। নৌকার কাত করানোর টেকনিকটাও খুব সুন্দর, যা চোখে না দেখলে বোঝানো বেশ কঠিন।
১০ নভেম্বর প্রায় দুপুর একটায় নববধূ সাজে বাপের বাড়ি থেকে পাড়ি দিল গুজরাটের উদ্দেশ্যে। থুড়ি পাড়ি দেয়নি, পাড়ি দেওয়ার জন্য অনুশীলন করে নিল। তার প্রস্তুতিও দিয়ে নিল। তবে গুজরাট পাড়ি দেওয়ার পথনির্দেশ এখন আলোচনা সাপেক্ষ।