বিনয় ভরদ্বাজ, অবতক খবর,২৬ জুলাই :: বিধানসভা নির্বাচনে যখন রাজ্যজুড়ে মমতা ঝড়ে বিজেপির স্বপ্ন একের পর ভাঙছে। ধরাশায়ী হয়েছে তাদের সব পরিকল্পনা, তাসের ঘরের মত মাটিতে মিশে গেছে তাদের হাওয়া মহল। তখন নদীয়া জেলার তৃণমূল হারিয়েছে একের পর এক জেতা সিট।১৭ টিতে ৯ টি সিট জেলার মধ্যে ছিনিয়ে নিয়েছে বিজেপি। সবচেয়ে খারাপ অবস্থা নদীয়া রানাঘাট-কল্যাণী জেলা পুলিশ এলাকায়। একটিও দখল করতে পারেনি তৃণমূল। কল্যাণী,হরিণঘাটা, চাকদহ ,রানাঘাট দক্ষিণ, রানাঘাট উত্তর পশ্চিম, রানাঘাট উত্তর পূর্ব, শান্তিপুর, কৃষ্ণনগর পর্যন্ত একের পর এক ধুয়ে মুছে সাফ হয়ে গেছে তৃণমূল।
এখন প্রশ্ন, এমন কি হলো যে রাজ্য জুড়ে যখন মমতার ঝড়, তোলপাড় বিজেপির স্বপ্নের কেন্দ্র, তখন এই জেলায় তৃণমূলের ভরাডুবি? এখানে একেবারে ধুয়ে মুছে গেল তৃণমূল, কেন? দলের এই ভরাডুবির বাস্তব কারণ জানতে উদ্যোগী হয়েছে এখন তৃণমূলের ওপরতলার নেতৃত্ব। একদিকে জেলার সবকটি পৌরসভা তৃণমূলের দখলে সবকটি পঞ্চায়েত সমিতি ও পঞ্চায়েত (পায়রাডাঙ্গা বাদে) তৃণমূলের দখলে অথচ বিধানসভায় একেবারে ধুয়েমুছে সাফ। নদীয়ার এই রেজাল্ট চিন্তায় ফেলেছে দলকে।
সামনে পৌর নির্বাচন আসন্ন। তারপরের বছর হতে চলেছে পঞ্চায়েত নির্বাচন। তাই দলকে এই হার থেকে বের করে, সংগঠনকে চাঙ্গা করতে উদ্যোগী দল। তবে প্রথমেই প্রশ্ন উঠছে নদীয়ার দায়িত্ব যার ওপরে ভরসা করে দিয়েছিলেন নেত্রী অর্থাৎ জেলার সভানেত্রী মহুয়া মৈত্রকে নিয়ে। জেলার দলীয় অন্তর্কলহ মেটাতে শংকর সিং এর হাত থেকে ক্ষমতায় নিয়ে মহুয়া দেবীর হাতে ক্ষমতা তুলে দিয়েছিল দল। কিন্তু তার নেতৃত্বেই দল নদীয়া জেলায় ধুয়ে মুছে সাফ হয়ে গেল। জেলা নেতারা বলছেন এই পরাজয়ের দায়িত্ব নিয়ে মহুয়া দেবীর জেলা সভাপতি পদ থেকে পদত্যাগ করা উচিত ছিল। কিন্তু তিনি তা করেননি। অবশেষে তৃণমূল সুপ্রিমো ও ওপরতলার নেতারাই এই জেলাকে ভাগ করে সংগঠন গোছানোর দায়িত্ব গ্রহণ করেছেন।
তবে জেলাকে ভাগ করে নতুন জেলা কমিটির নেতা নির্বাচিত করার আগে দলকে হারের আসল কারণ পর্যালোচনা করার প্রয়োজন অবশ্যই রয়েছে। কেন হল দলের এই ভরাডুবি, তার কারণ খুঁজতে গিয়েই প্রথমে উঠে আসছে জেলা সভাপতি ও নেত্রী মহুয়া মৈত্র এর নাম।
দল নিজের মতো করে তদন্ত করছে। অবতক খবর এর পক্ষ থেকে তৃণমূলের এই পরাজয়ের কারণ খুঁজে বার করতে তদন্ত করে দেখা মিলেছে বেশ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ন কারণ। যে সকল তথ্য উঠে এসেছে তা এই লেখার মধ্য দিয়ে তুলে ধরা হল।
নির্বাচনের আগে জেলার সভাপতি ও নেত্রী মহুয়া মৈত্র দলকে সংগঠিত করে দলের নেতাকর্মীদের চাঙ্গা করে তোলার বদলে তিনি নিজেকে বড় নেত্রী হিসেবে তুলে ধরতে ব্যস্ত ছিলেন। শুধু তাই নয়, ঘর গোছানোর বদলে তিনি মিডিয়ার সঙ্গে লড়াই করতে বেশি ব্যস্ত হয়ে পড়েছিলেন।তিনি বড় নেত্রী, মিডিয়া কর্মীরা দু পয়সার সাংবাদিক,এই জাতীয় মন্তব্য করে তিনি বিতর্কে জড়িয়ে যান। মিডিয়া শুধু তার ঘরের ভেতরে কি হচ্ছে তুলে ধরে তাকে অবগত করার চেষ্টা করেছিল মাত্র,তাতে তার নাকি আঁতে ঘাঁ লেগেছে । আর তিনি ঘর ছেড়ে ঘরের বাঁধন তৈরি না করে মিডিয়াকেই আক্রমণ শুরু করে দেন। যাক যা হবার কথা ছিল সেটাই হয়েছে । দলকে ওপরে থেকে ফিটফাট দেখানোর অসফল চেষ্টা যে মহুয়া দেবী করে গেছিলেন তা ফল প্রকাশের পর পরিষ্কার হয়ে গেছে।
জেলার নেতারা বলেছেন যে, মহুয়া দেবী ভালো বক্তা। ফিটফাট শিক্ষিত নেত্রী। তিনি দিদির প্রিয় পাত্র। কিন্তু তিনি দক্ষ সংগঠনিক নেত্রী এক্কেবারে নন। দলকে, দলের সকল নেতাকর্মীদের সঙ্গে নিয়ে চলার মতো দক্ষতা এবং যারা দলের সিদ্ধান্তের বাইরে গিয়ে কাজ করছেন বা কথা বলছেন তাদের দাপটের সঙ্গে দলীয় শৃঙ্খলা মানতে বাধ্য করার মত ক্ষমতা মহুয়া দেবীর নেই। নির্বাচনের আগে মহুয়া দেবীর হাতে নদীয়া জেলার দলের সংগঠনের দায়িত্ব তুলে দেওয়া সিদ্ধান্ত নিয়ে উপর তলার নেতারা বা নেত্রী ভুল করেছেন তা আজকে পরিষ্কার।
তবে প্রশ্ন , শুধুই কি মহুয়া দেবীর গাফিলতি, শুধুই কি তার নেতৃত্বের কারণেই কি এই পরাজয়? না, তা এক্কেবারেই নয়। নদীয়া জেলার এই পরাজয়ের কারণ ব্যাখ্যা করতে গেলে জেলা নেত্রীর পাশাপাশি দলীয় অন্তর্কলহ সবচেয়ে বড় পরাজয়ের কারন। দলের ভেতরে দলের শত্রুরা লুকিয়ে রয়েছেন আর তাদের চিহ্নিত করে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার মতন দক্ষতা ও সাহস মহুয়া দেবীর নেই।
তাই এখন হারানো জমি উদ্ধার করতে গেলে দল নদীয়াজেলাকে দুভাগ করে ঢেলে সাজাতে চলেছে। তাতে দলকে যেসব বিষয় বস্তুর দিকে নজর দিতে হবে তা উল্লেখযোগ্য হলো::-
1. নদীয়ার ভরাডুবি থেকে বেরিয়ে আসতে গেলে বলিষ্ঠ নেতৃত্ব প্রয়োজন। তিনি সকলকে নিয়ে চলতে পারবেন ও চলতে বাধ্য করবেন এমন নেতৃত্ব বেশি প্রয়োজন।
2. যেহেতু দলের পরাজয়ের জন্য দলীয় অন্তর্কলহ একটি মূল কারণ, তাই অন্তর্কলহ মেটাতে জেলার নেতৃত্ব রাজ্য নেতৃত্ব কেউ বড় ভূমিকা পালন করতে হবে।
3. জেলার এমন নেতৃত্বের হাতে ক্ষমতা তুলে দিতে হবে, যার জেলার বুকে গ্রহণযোগ্যতা থাকে অর্থাৎ তার বেশ ভালো থাকতে হবে। তাছাড়াও তার দলের উপর নিয়ন্ত্রণ থাকে এবং যে কোনো আর্থিক দুর্নীতির সঙ্গে জড়িয়ে না থাকেন।
4. জেলার দায়িত্ব এমন মানুষকে দিতে হবে যে সংগঠন বোঝে এবং তার সাংগঠনিক দক্ষতা যেনো থাকে।
5. দলের শত্রুদের চিহ্নিত করে তাদের বিরুদ্ধে কড়া পদক্ষেপ গ্রহণ করা ও তার স্বচ্ছ ভাবমূর্তিদের সামনে এনে কাজ করতে হবে।
তাছাড়াও নদীয়া জেলার এই ভরাডুবি থেকে বেরিয়ে আসতে দলকে আরও বেশি চ্যালেঞ্জের মুখে পড়তে হবে। তার কারণ মতুয়া সমাজের নদিয়ায় উল্লেখযোগ্য সংখ্যা এবং বিজেপির মতুয়াদের নিয়ে নতুন রণকৌশল।
রানাঘাট-কল্যাণী জেলা পুলিশ অঞ্চলে যেসমস্ত সিটগুলিতে তৃণমূলের ভরাডুবি হয়েছে সেসব সিট এসসি ,এসটি এবং মতুয়ারা বড় ফেক্টর। এখানে মুসলিম ভোটার একেবারেই নগণ্য বললেই চলে। তাই দলকে শুধু মুসলিম ভোটারদের কথা না ভেবে মতুয়া এস সি, এস টি, দের নিয়ে বেশি করে ভাবতে হবে।
উপরের উল্লেখিত কারণগুলির বিবেচনা না করে যদি কোনো নড়বড়ে নেতৃত্বের হাতে তৃণমূল তার নদীয়া জেলার ক্ষমতা তুলে দেয় তাহলে আসন্ন নির্বাচনে ফল কি হবে তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না।