নেতাজির ১২৩- তম জন্মদিন। আমার মেয়ে টুকুন কী বলছে, শুনুন
নেতাজি টুকুন ও আমি
তমাল সাহা
আমার মেয়ে টুকুনকে নিয়ে আমার এখন নিত্য সমস্যা। ২৩ জানুয়ারি রাত আটটা। টুকুন এসে দাঁড়ালো আমার সামনে।
রাগত কন্ঠস্বর তার।
কজন মনীষীর জন্মতারিখ জানো তুমি?
কেন? জন্মতারিখ দিয়ে কি হবে?
আমি জানি তুমি কেন, তোমার মতো মানুষ যারা এই সমাজে বিজ্ঞ বিজ্ঞ ভাব নিয়ে ঘুরে বেড়ায় তারা কেউই দুজন মনীষীর জন্মতারিখ ছাড়া অন্য কারুর জন্মদিন একনাগাড়ে বলে যেতে পারবে না।
বড় মুখ করে কড় গুণে গুণে বলবে—
পঁচিশে বৈশাখ, রবীন্দ্রনাথের জন্মদিন।
তেইশে জানুয়ারি, নেতাজির জন্মদিন।
ব্যস! ব্যস!তারপর ভাবতে থাকবে যেন আরও কত মনীষীর জন্মদিন জানো তোমরা!
তেইশে জানুয়ারি। সে কি হইচই! নেতাজি ফিরে এসো।
দশটায় নেতাজির জন্মমুহূর্ত। দিগ্বিদিকে শঙ্খধ্বনি বেজে ওঠে।
জানো তো, নেতাজির জন্মদিন পাল্টে গেল।
তেইশে জানুয়ারি হয়ে গেল বিবেকানন্দের জন্মদিন। খান্যাডিহি গ্রাম পঞ্চায়েতে তেইশে জানুয়ারি বিবেকানন্দের প্রতিকৃতিতে মাল্যদান করলেন রাজ্যের নেতারা
যারা একদিন দেশের নেতা হয়ে উঠবেন।
আমি বলি, তাই কি টুকুন?
তুমি কি জানো সেই পঞ্চায়েতে উল্টো করে জাতীয় পতাকা উত্তোলন করা হয়েছে।
ও এই কথা? সরকারের পরিবর্তন হয় আর মনীষীদের জন্মদিনের পরিবর্তন হবে না! জাতীয় পতাকা উল্টো করে উঠবে না? তাই কি হয় ?গেরুয়া নীচে, সবুজ ওপরে এই তো? সামান্য রঙের ওপর নীচে কি এসে যায় টুকুন? আর স্বামীজির জন্মদিনের দিন নেতাজির জন্মদিন পালন করলেই তো শোধবোধ হয়ে যাবে!
বাবা, বিষয়টা কি এতই সহজ?
টুকুন, সব বিষয়কে সহজ করে নিতে হয়। এত জটিল করে দেখলে চলে?
আর মনীষী? মনীষীরা কি আমাদের এই নেতাদের চেয়েও বড়?
বাবা, এবার প্রজাতন্ত্র দিবসের কুচকাওয়াজে
যে র্যালি হল, যে ট্যাবলো তৈরি হল তাতে গান্ধীজির মূর্তি ছিল, রবীন্দ্রনাথের মূর্তি ছিল, নেতাজির মূর্তি ছিল না।
নেতাজি! নেতাজির মূর্তি থাকবে কেন? নেতাজি কি বাংলার সন্তান? সে তো ওড়িষার কটকে জন্মেছিল। সে তো সেখানকার ভূমিপুত্র। তাকে এত গুরুত্ব দেব কেন? নেতাজি দেশের জন্য কোন কাজটা করেছে? নেতাজি তো পলায়নবাদী! দেশের জন্য সম্মুখ সমরে নেমেছে। সে তো গদির জন্য গোলামি করে নি। দাসখত লেখেনি! গোপনে শলাপরামর্শ করে দেশের বুকে করাত চালিয়ে তাকে দুখন্ড করে মধ্যরাতে স্বাধীনতা আনেনি। সে তো হিন্দু, মুসলমান, জৈন, খ্রীষ্টানকে এক করে, নারী পুরুষকে একাকার করে আজাদ হিন্দ ফৌজ গড়েছে। সে সশস্ত্র অভিযান চালিয়েছে। তাঁর মূর্তি থাকবে কেন? সে তো গান্ধিজির পাল্টা লড়াই করেছে। সে তো জঙ্গি সন্ত্রাসবাদী। তাঁর মূর্তি থাকবে?
টুকুন কেঁদে ফেলল।
বাবা, ওঁকে ওরা কুইসলিং বলেছিল। বলেছিল তোজোর কুকুর। তোজোর সঙ্গে নেতাজির দেখা হয়েছিল। হিটলার ও মুসোলিনির সঙ্গে করমর্দন করেছিলেন নেতাজি। কেন? কেন করেছিলেন? সে তো নিজের দেশের জন্য। নেতাজি আসলে বাঙালির বাচ্চা ছিল— সাচ্চা বাচ্চা। তাঁর রক্তে ছিল ভারতীয় চেতনার স্রোত।
বাবা, আসলে ওরা নেতাজিকে ভয় পেয়েছিল। ওরা এখনও ভয় পায়। তাই তারা এখনও বলতে চায় না নেতাজি ছিল কোথায়? আমরা তো জানি নেতাজি আছে আমাদের মণিকোঠায়।
বাবা, জানো ওরা কারা? আমি জানি। আমি নিশ্চিত করে জানি। এক এক করে বলে দিতে পারি ওদের নাম। ভারতীয় গোয়েন্দারা যা পারেনি, আমি খোলাখুলি বলে দিতে পারি কারা নেতাজির বিপক্ষে ছিল। কারা আজাদ হিন্দ ব্যাঙ্কের কোটি কোটি টাকা গায়েব করে দিয়েছিল, আজাদ হিন্দ ফৌজের স্মৃতিসৌধ গুঁড়িয়ে দিয়েছিল।
সে বার বার বলে, বাবা, আমি জানি।
আমি টুকুনের চিবুকে হাত দিয়ে উঁচু করে দেখতে থাকি—
আমার মেয়ের মুখখানি।