আজ বেলা সাড়ে তিনটেয় চলে গেলেন মন্টু রক্ষিত, আমাদের পাড়ার মন্টুদা। তিনি রাজনৈতিকভাবে সিপিএম দলের সদস্য ছিলেন। আমার চোখে পাড়ার মানুষ হিসাবে কেমন ছিলেন তিনি।
— মন্টু দা! ও মন্টু দা!
— ঐ মইন্টা! তরে তমাল ডাকতাছে। এমনভাবে মন্টুদাকে জানালেন মন্টুদার মা।
—- কি হইছে রে তমাল?
—- ঐ দ্যাখোনা আবার জল লইয়া গণ্ডগোল লাগছে।
আগে পাড়ায় এই ঝামেলা হামেশাই লেগে থাকতো।মন্টুদা এলেই ফয়সলা হয়ে যেতো। ১৫ নং ওয়ার্ড-এর ঘটনা। কবরস্থান থেকে যে রাস্তাটা প্রয়াত প্রাক্তন কাউন্সিলর প্রফুল্ল সরকার সরকারের বাড়ির দিকে গেছে সেই অঞ্চলের ঘটনা।
মন্টু রক্ষিত আমাদের পাড়ায় থাকেন। আজ বলতে হচ্ছে থাকতেন। ছোটবেলা থেকে তাঁকে দেখে আসছি। পাড়া প্রতিবেশীদের মধ্যে সাধারণ ঝগড়াঝাটি বা বড় গন্ডগোল তিনি মিটিয়ে দিতেন। ভালো পড়শি, ভালো মানুষ বলতে যা বোঝায় তিনি তা ছিলেন।
তিনি যখন ট্রেড অ্যাপ্রেন্টিস করতেন কাঁচরাপাড়া রেলওয়ে ওয়ার্কশপে তখন থেকে তাঁর সঙ্গে আমার পরিচয়। কংগ্রেসী শাসনের সময় বিভিন্ন ছাত্র যুব আন্দোলনে তাঁকে দেখেছি। সক্রিয় ভূমিকা নিয়েছিলেন তিনি সেইসব আন্দোলনে। তিনি সিপিএম করতেন।
অনেক সিপিএম আমি দেখেছি। ‘সেইসব সিপিএমদের’ থেকে তিনি অন্য ধরনের সিপিএম ছিলেন। তিনি সিপিএম পার্টির সদস্য ছিলেন। তিনি সেই সিপিএম ছিলেন না। সেই সিপিএম বলতে যা বোঝাতে চাইছি নিশ্চিত তা বুঝতে পারছেন। তাহলে সোজা কথায় বলি। তিনি ধান্দাবাজ, তোলাবাজ সিপিএম ছিলেন না এবং তেমন ক্ষমতাও তাঁর ছিল না।
তিনি বাবলু রক্ষিতের সঙ্গী ছিলেন, তাঁর সঙ্গে তাঁর ঘনিষ্ঠ বন্ধুত্ব ছিল। তাঁর সঙ্গে সান্নিধ্য দেখেছি। ১৫ নং ওয়ার্ডের কমিশনার প্রফুল্ল সরকারকে তিনি অত্যন্ত সম্মান দিতেন।
তিনি ৭৪-এর সেই ঐতিহাসিক রেল ধর্মঘটে অংশগ্রহণ করেছিলেন। পার্টির সঙ্গে নিশ্চিতভাবে তিনি সংযোগ রক্ষা করে চলতেন। এসব মানুষ একটু অন্য ধরনের রাজনৈতিক কর্মী। ১৯৬৬-র খাদ্য আন্দোলনের সঙ্গেও তিনি যুক্ত ছিলেন। তিনি কবি সুকান্ত ভট্টাচার্যের হাতেগড়া কিশোর বাহিনীর কাঁচরাপাড়া শাখা সংগঠনের সঙ্গেও যুক্ত ছিলেন।এক কথায় বলতে পারি মন্টুদা ভালো মানুষ ছিলেন। ‘এই ভালো’ হওয়াটা খুবই কঠিন কাজ।
এক একটা মানুষ থাকেন,যাদের অদ্ভুত গুণ থাকে, তাদের ভালোবাসা যায়। সেই গুণটি মন্টুদার ছিল। মন্টুদা ক্লাব সংগঠন করেছেন। জনকল্যাণ সমিতির প্রাণ পুরুষদের মধ্যে নিশ্চিত উনি ছিলেন একজন। যে মহাজাতি ক্লাবের এত পরিচিতি,সেই মহাজাতি ক্লাবের অন্যতম নেতৃত্বে ছিলেন তিনি। মান্ধারী বাজার স্পোর্টিং ক্লাবের সঙ্গেও অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ ছিলেন তিনি। রাজনীতিগ্রাসী এই দেশ। রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের ফলে কতসব ঘটনা ঘটে যায়। সে সব আর উল্লেখ করছিনা।
রাজনীতি মানুষকে যেমন বড় করে তেমন ছোটও করে!
ছোট্ট একটি ঘটনার কথা বলি। কাঁচরাপাড়া উৎসবকেন্দ্রিক গায়ক সোনু নিগমের আগমন নিয়ে একটি বিতর্ক তৈরি হয়েছিল আমার প্রয়াত সিপিএম নেতা বাবলু রক্ষিতের সঙ্গে। সোনু নিগম অধিক রাতে অনুষ্ঠান করতে আসেন। আমার পরিচালিত সংবাদপত্রে এই ঘটনা সম্পর্কিত একটি সংবাদ প্রকাশিত হলে বাবলু রক্ষিত প্রবাহ ক্লাবে ডেকে এনে আমাকে খুব দাবড়ে ছিলেন। এই দাবড়ানোটি যে অন্যায়,সেই ঘটনার সময় উপস্থিত ছিলেন বর্তমান নেতৃত্ব শম্ভু চ্যাটার্জী,মন্টুদা ,গোপীদা এবং অন্যান্যরা। তারা বুঝেছিলেন যে বিষয়টি সঠিক হচ্ছে না। পরবর্তীতে বাবলু রক্ষিতকে মন্টুদা বলেছিলেন যে বিষয়টি সঠিক হয়নি বাবলু। ওর সঙ্গে এই আচরণ করা যথার্থ হয়নি। সে স্বজন হোক আর পার্টির লোক হোক তিনি আমার পক্ষই সমর্থন করেছিলেন। বয়সের প্রান্তিকে এসে সে কথা মনে পড়ছে।
মন্টুদার একটা দু্ঃখ ছিল। রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের কারণে একটি সামাজিক অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদে গর্জে উঠতে পারেন নি তিনি। তার বাড়ির বার বারন্দা লাগোয়া নিত্যদিন একটি ‘স্ট্যান্ডিং সান্ধ্যপান’-এর জটলা হতো। রাজনৈতিক মদতপুষ্ট আঞ্চলিক পরিচিত মুখের যুবরা এতে জড়িত। মন্টুদার মতো দাপুটে মানুষের বাড়ি সংলগ্ন এ ঘটনা,এ যুব অধঃপতন ভাবা যায়! রাজনৈতিক কারণে এবং অসম্মানিত হবার ভয়ে মন্টুদা এর প্রতিকারের ঝূঁকি নিতে চান নি। মন্টুদা বলেছিলেন, অন্য সময় হলে এদের চড় থাপ্পড় তো মারতামই, প্রকাশ্যে কানধরে ওঠবস করাতাম।কারণ এ ঘটনা পাড়ার সকলেই জানে।এরা বয়স্ক নারী-পুরুষ মানে না। রাজনৈতিক কারণে প্রতিবাদে ভয় পায়। ‘হায়,সময়!’ বলে এক দীর্ঘশ্বাস ছেড়েছিলেন তিনি।
মৃত্যুর পর কি রাজনীতির ঊর্ধ্বে উঠে গিয়েছিলেন মন্টুদা? পার্টির পক্ষ থেকে তাঁর মরদহে মাল্যদান করা হয়েছিল তাঁর বাড়িতে এসে। কিন্তু তাঁর মরদেহ লাল পতাকায় আবৃত ছিলনা বা তাঁর মরদেহ পার্টি দপ্তরে নিয়ে গিয়ে স্যালুটও জানানো হয়নি। অথচ তিনি অন্তত পক্ষে কুড়ি বছর লোকাল কমিটির মেম্বার ছিলেন।
ক্রীড়াপ্রেমী মন্টুদার মরদেহে জনকল্যাণ সমিতি, একটি অরাজনৈতিক সংগঠন শ্রদ্ধাজ্ঞাপন করে। সেই সময় তাঁর মরদেহ রক্তলাঞ্ছিত লাল পতাকায় আবৃত করে দেন সিপিএম নেতা শম্ভু চ্যাটার্জি।
হে পার্টি তুমি কোথা হইতে আসিয়াছ, কোথায় গিয়াছ?
মন্টুদা মাল্টিঅরগান ফেইলিওর-এ আজ বেলা সাড়ে তিনটেয় চলে গেলেন। তিনি বি আর সিং হাসপাতালে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন।
আমার মাথাটি অবনত হয়ে এলো।
লকডাউনে লক ফ্রি হয়ে গেলেন মন্টুদা।