অবতকের বিশেষ প্রতিবেদন
আজ ২০ জুলাই, ছিল সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী দিবস। সেটা ১৯৭৬ সাল। উত্তাল হয়েছিল কলকাতা আর সেই আলোড়ন সৃষ্টিকারী রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসের ঘটনা ঘটেছিল কার্জন পার্কে। এখন আমরা সাম্রাজ্যবাদকে নয়া রূপে দেখছি আর আমাদের ঘরের ভেতরে শুনতে পাচ্ছি, স্বৈরাচার ও ফ্যাসিবাদের যৌথ পদশব্দ।
প্রবীরের লাশ
তমাল সাহা
কি লিখবো আজ আমি! গঙ্গা দিয়ে অনেক প্রবাহ বয়ে গিয়েছে। তার তীরে পলল মাটি থিতিয়ে পড়েছে। তার তলা থেকে কিভাবে জীবাশ্ম উদ্ধার করবো ? রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসের মাত্রা বাড়তে থাকে,আর দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হতে থাকে আমার সাহস। কলকাতার দিকে তখন আমার ঘনঘন পদক্ষেপ। আমি তো সব দৃশ্য ভাষাময় করতে চাই চোখের তারায়।প্রতিবাদ হবে, মিছিল হবে, এই সংবাদ আমার কাছে তখন সুসংবাদ। কারণ এসবই তখন আমার ভালোবাসার, হৃদয়ের, অন্তরের কাছের।
কলকাতা তখন আমাকে তাড়িয়ে বেড়াচ্ছে। অনেক লাশ দেখেছি আমি, সে তো মৃত! কিন্তু প্রবীরের লাশ? পুলিশের এমন দমাদম লাথি, পেটাই স্বচক্ষে দেখে সহ্য করেছিলাম আমি।
কলকাতা শহরে মেঘ উড়ে আসে। ঘন অন্ধকার নেমে আসে রাজভবনের বিশাল চত্বর পেরিয়ে এই কার্জন পার্কে। ২০ জুলাই এলে মাথা ঝুঁকিয়ে কার্জন পার্কের দিকে তাকিয়ে থাকে আকাশ। মেরুদণ্ড সোজা করে মাথা উঁচু করে দাঁড়ায় সেই, সেইদিনের রক্তমাখা ঘাস। কারণ ২০ জুলাই ছিল প্রবীরের নব জন্মমাস। সেই ২০ জুলাই আমি কোথায়? আমি তখন এই কার্জন পার্কের ভেতর। জনারণ্যে মিশে আছি।
২০ জুলাই ১৯৭৬। সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী দিবস। সাংস্কৃতিক কর্মীরা নির্মাণ করেছিল এই সংগঠন। সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী কমিটি। তারই মধ্যে কার্জন পার্কে অনুষ্ঠিত হয়েছিল গান, নাটক। কার্জন পার্কের আনাচে কানাচে সমাবেশের আগে থেকেই উর্দি পরা ও সাদা পোশাকের পুলিশ নজরদারি রেখেছিল। গান, নাটকেই কি অনুষ্ঠান শেষ হতে পারে? না পারে না। চাই দুর্জয় সোচ্চার প্রতিবাদী মিছিল। কারণ প্রবীরেরা আছে। দৃপ্ত প্রাণের জোয়ার আছে। পার্ক থেকে মিছিল বেরোনোর মুখে পুলিশ মিছিলের কমরেড যার গায়ে লেগেছিল লড়াকু ঘামের গন্ধ, সেই দেবর্ষি চক্রবর্তীকে গ্রেপ্তার করে তুলে নিয়ে গিয়েছিল কালো ভ্যানে। মিছিলের জোয়ার ফুঁসে উঠেছিল। প্রতিবাদ জানিয়েছিল সাংস্কৃতিক কর্মীরা।
আর সেই প্রবীর দত্ত! তাকে ঘিরে ফেলল পুলিশ। মাথায়, ঘাড়ে দমাদম মারতে লাগলো। উপুড় হয়ে পড়ে গেল প্রবীর। তারপর? বুট পায়ে পেটে বুকে লাথি চালালো পুলিশ। দুর্ধর্ষ প্রবীরকে মেডিকেল কলেজে নিয়ে গেল প্রতিবাদী সাংস্কৃতিক কর্মীরা। মরে গেল প্রবীর।
প্রবীরেরা কি মরে? চন্দ্রনাথ চ্যাটার্জী স্ট্রিটের প্রবীর ছড়িয়ে পড়লো গাঙ্গেয় উপত্যকা জুড়ে। প্রবীরের প্রাণহীন শবকে ভয় পেল পুলিশ। মৃত প্রবীরের দেহ ফিরে পেতে কাতর অনুরোধ সত্ত্বেও প্রবীরের মা রাণু দত্তের আবেদন নাকচ করেছিল পুলিশ। কঠোর পুলিশ পাহারায় শ্মশানে চলে গেল বঙ্গজ বাতাস কাঁপানো প্রবীরের লাশ।
পোস্টমর্টেম, ময়নাতদন্তের রিপোর্ট কি বলেছিল?
আপাত কারণে অর্থাৎ পেটের খাদ্যদ্রব্য গলায় উঠে গিয়ে শ্বাসনালী রুদ্ধ হয়ে যুবকটির মৃত্যু ঘটেছে। এ কোন যুবক! এ তো দুর্ধর্ষ যুবক। বলা হয়েছিল পুলিশের লাঠিতে হঠাৎ মাটিতে পড়ে যাওয়া ও পেটে বুকে জোরে লাথি পড়ার ফলে মৃত্যু হবারই সম্ভাবনা প্রবল। ওই রিপোর্টে আরও বলা হয়েছিল পাঁজরার একটি হাড় ভেঙে গিয়েছিল। এ কোন হাড়? এ তো সেই দধীচির হাড়। মগজে কার্ফু হয়ে গেছে। সন্ত্রাস নেমে এসেছিল নাগরিক জীবনে। আমি দেখেছিলাম স্বচক্ষে সেই জনতা আর পুলিশের সংঘর্ষের দৃশ্য। সোচ্চারে কিকরে প্রতিবাদী সাংস্কৃতিক কর্মীরা কথা বলে, তা আমি দেখেছিলাম সেদিন। আর রাতে ফিরে ঘরের এক কোণে বসে মুখ বুঁজে লিখে ফেলেছিলাম কাঁচা হাতে কয়েকটি অক্ষরসজ্জা–
মাটিতে জন্ম যার
সে তো মাটিকেই বাসবে ভালো।
মৃত্যুতেও সে মাটিকেই চায়
তাই তো রক্তাক্ত দেহ তার
মাটিতেই গড়ালো।
রাষ্ট্রের পদদলিত শ্বাসরুদ্ধ
প্রবীরের লাশ
শয্যা পেতে দিয়েছিল
বিস্তীর্ণ সবুজ ঘাস।
বাতাস পর্যন্ত এসেছিল ছুটে
মাথার সামনে দাঁড়িয়ে ফেলেছিল
প্রলম্বিত তার দীর্ঘশ্বাস।