বহুরূপী নারীদের কাছে আমি

প্রিয়ারা সুধারা কাছে চলে আসে
তমাল সাহা

ঋতুরা প্রকৃতিতে হেঁটে চলে। মৃত্যুর গন্ধ পাইনা আমি।এবড়োখেবড়ো বন্ধুর পথে জীবন হেঁটে চলে।

বিজয়া দশমী চলে গেছে বেশ কয়েকদিন আগে।অমাবস্যাতে দেয়ালির আলো জ্বলবার কদিন আগে হিম হিম রাতে আমি ঢুকে পড়ি রূপার ঘরে।
সেই রূপা গো! আমার বন্ধুনি রূপাজীবা।

কিগো, ভুত দেখছি নাকি! এই বলে গলায় আঁচল জড়িয়ে আমাকে ঢুপ করে প্রণাম করে রূপা। রূপাকে ছাড়া আর আমি কাউকেই পা ছুঁতে দিই না। রূপাকে ছাড়া আমি আর কারো মাথায় হাত দিয়ে আশীর্বাদ করি না।

আজ খবরের কাগজে যে মেয়েরা অমাবস্যার রাতে বহুরূপী কালী সেজে বেরুবে ভিক্ষেপাত্র হাতে তাদের একজনের ছবি দেখি। মিথ্যে বলবো না, সেই মেয়েটির ছবি দেখেই তোমার মুখটি ভেসে উঠলো রূপা।
মুখ বেঁকিয়ে রুপা বলল, আমি তো সিজনাল বহুরূপী নই। আমি তো রোজই বহুরূপী রূপাজীবা। তুমিই তো আমাকে শুনতে ‘অশ্লীল ওই শব্দটা’ বদলে এই শব্দটা শিখিয়েছো। তুমি বলেছিলে, যৌন শব্দটার মধ্যেই একটা যৌনতা লুকিয়ে আছে। তাই যৌনকর্মী না বলে রূপাজীবা শব্দটাই শুনতে ভালো।অভিমান করলে রূপার গালে অবশ্যই ঐশ্বর্যময়ী টোল পড়ে।

সত্যজিৎ রায় ‘কাপুরুষ মহাপুরুষ’ ছবিতে রবি ঘোষকে বহুরূপী সাজিয়েছেন, ঋত্বিক ঘটক ‘সুবর্ণরেখা’ ছবিতে বহুরূপী কালিকাকে দেখিয়েছেন। আমি বলি, রূপা সিনেমায় উপন্যাসে মেয়েদেরই এতো বহুরূপী সাজে দেখায় কেন গো?
রূপা বলে, এসব বুঝি তুমি জানো না! কালী আদ্যাশক্তি মহামায়া। নারীদের নগ্নতা দেখায় একটা মাধুর্য তো আছে বটেই। নানুরের বিখ্যাত বহুরূপী সুবল দাস বৈরাগ্য তো শুধু কালী কেন নর্তকী, কলেজ গার্ল, বার গার্ল মিস মিতার বিভিন্ন বিভঙ্গে মুদ্রায় সংলাপে পেটের দানাপানি জোগাড় করে। এমনই তো শুনেছি।
আমি বলি, সুবোধ ঘোষের ‘বহুরূপী’ গল্পে হরি দা সাধু সন্ন্যাসী পাগল অনেক কিছুই সাজতো। তবে বাইজি সেজেই সবচেয়ে বেশি উপার্জন করেছিল। দশ টাকা কত আনা যেন!
মাস্টারদার শিষ্যা কল্পনা দেশপ্রেমের ভিক্ষা চেয়ে পুরুষবেশ আমার উত্তেজনা বাড়িয়ে দেয়।

হেমন্তের এই হিমঝরা বেলায়, বসন্তের শেষ বেলা চৈত্র সংক্রান্তি আর গাজনের মেলায় আমি কত শ্যামা শ্মশান কালী পার্বতী অন্নপূর্ণা দেখি। আশ্চর্য অর্ধনারীশ্বরও দেখি।

রূপা বলে, অর্ধনারীশ্বর সেটা আবার কি? আমি বলি, বহুরূপীর অর্ধেকটা কালী সাজ এবং অর্ধেকটা মহেশ্বর। রূপা বলে, তোমার চোখও বটে!

শোনো, আমাদের নদীয়ার শান্তিপুরে, বাঁকুড়া বীরভূমের বিভিন্ন জায়গায় এমন অনেক বহুরূপী পাড়া আছে।
এই তো এবার কবিতাকে নিয়ে ঝুলন মেলায় গিয়েছিলাম। লিভিং মডেল ধ্যানরতা সারদা দেবীকে দেখলাম। দেখলাম লিভিং তারকা রাক্ষসী। আমরা তো বেশ রাত করে গিয়েছিলাম। তখন ওদের ডিউটি প্রায় শেষ হয়ে এসেছে। সাজগোজ মানে মেক আপ ধুয়ে মুছে ওরা যখন ঝুলন মেলা থেকে বেরুচ্ছে তখন ওদের সঙ্গে কথা বলি।
সুধা সেজেছিল মা সারদা আর তারকার রাক্ষসী সেজেছিল প্রিয়া মন্ডল।
সুধা বলে, মেলায় বিসর্জনের মিছিলে আমি লিভিং মডেল সাজি। ঘন্টা চুক্তিতে আমাদের রোজগার। দাঁড়ানো মডেল হলে বেশি রেট দিতে হবে। বসে থাকা মডেল হলে রোজ একটু কম। বহুরূপী সেজে এমনভাবে দাঁড়িয়ে বা বসে থাকবো কোনো অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ এমনকি চোখের পাতা পর্যন্ত নড়বে না। কেউ চিমটি কাটলেও সহ্য করে নেব।
প্রিয়া বলে, আমাদের এসব সহ্য হয়ে গিয়েছে। আমরা শান্তিপুর থেকে এসেছি।
সুধা বলে, আমরা সারদা, নিবেদিতা, তারকা রাক্ষসী, ডাইনি, ঝাড়ুদারনী, মাতঙ্গিনী হাজরা, আধুনিকা মডেল, হিজড়ে সব সাজতে পারি।

বে- সিজনে আমরা মাকুর শব্দে তাঁত বুনি, মাঠে চাষ করি। কোনো কোনো মেয়ের রাস্তার ধারে চায়ের গুমটি আছে। কেউ সবজি বিক্রি করে। কেউ কেউ স্বামী স্ত্রী মিলে চপ ঘুগনির দোকান করে।
বিশেষ করে অমাবস্যায় দিওয়ালিতে আমরা কালী সেজে শহরের রাস্তায় এমনকি কলকাতায় চলে যাই। আমাদের অনেকে বারাসাতেও চলে যায়। সেখানে তো কালীপুজোর এক বিরাট মেলা। নগর শহরের মানুষ তো! এরা আমাদের এই সাজ দেখে খুব খুশি হয়। হাত পেতে ভিক্ষে করে আমাদের সংসার বাঁচে। মা কালী বলে কথা! ভয় ও ভক্তিতে মানুষ একটি একটু বেশি দান করেই ফেলে বলে আমার মনে হয়।
প্রিয়া বলে, আমাদের সাজ পোশাক মেকআপ আমরা নিজেরাই শিখে নিয়েছি। এবার বহরমপুরের এক কালীপুজো কমিটির থিম জীবন্ত দেবীদের মডেল। এবার আমরা সেখানে যাবো। এবার একটু আয় বেশি হবে।

রূপাই এসব কান পেতে শোনে। রূপা বলে, তুমি যাই বলো আমাদের মত সাহস স্পর্ধা দেখিয়ে পরনিন্দা পরচর্চাকে তুড়ি মেরে উড়িয়ে দিয়ে কোনোদিন তরুণী, কোনোদিন যুবতী, কোনোদিন মধ্যবয়স্কা জীবন্ত বহুরূপী হয়ে জীবন উপভোগ করতে পারে কোন বহুরূপী?

আমরা তো শুধু বহিরঙ্গে বহুরূপী নই গো! আমরা অন্তরঙ্গেও বহুরূপী/
এই দেহ মন না দিলে কি করে তোমার সঙ্গ করি চুপি চুপি/
বহু রূপে সম্মুখে তোমার ছাড়ি কথা খুঁজিছো ঈশ্বরী/
হায় গো আমি তো মহাকালনায়িকা! রোজই তোমার প্রেমে পড়ি