বাংলার মুখ পুড়লোঃ পিজি-এসএসকেএম হাসপাতাল ও উডবার্ণ ওয়ার্ড– একটি কেচ্ছা কাহিনী
তমাল সাহা
গাঙ্গেয় উপত্যকায় রাজনীতির কারবারিদের দৌরাত্ম্যে পিজি হাসপাতাল নয়, বাংলার স্বাস্থ্য পরিষেবা তো বটেই বাংলা ও বাঙালির মুখ পুড়লো। বাংলার মহামান্য হাইকোর্টই বাংলার স্বাস্থ্য পরিষেবা সম্বন্ধে সন্দেহ প্রকাশ করলেন এবং সরাসরি একজন ক্যাবিনেট মন্ত্রী যিনি গ্রেপ্তার হয়েছেন তাঁর স্বাস্থ্য বিষয়ক রিপোর্টে সন্দিগ্ধ হলেন এবং রিপোর্টের স্বচ্ছতা প্রমাণের জন্য অভিযুক্ত মন্ত্রীকে ভুবনেশ্বর এইমস্-এ পাঠিয়ে দিলেন। রাজ্যের ইতিহাসে এটি কলঙ্কজনক ঘটনা হয়ে থাকবে।
প্রেসিডেন্সি হাসপাতাল– প্রতিষ্ঠা হয় ১৭০৭ সালে। প্রেসিডেন্সি জেলের নাম শুনেছেন নিশ্চিত,তার কাছাকাছি অঞ্চলে এর অবস্থান। এর্ই কারণে এর নাম রাখা হয় প্রেসিডেন্সি হসপিটাল। এই হসপিটালটি নির্মাণের উদ্যোগ গ্রহণ করেন ফোর্ট উইলিয়াম কাউন্সিল। এটিতে আগে সাহেব সুবোদেরই চিকিৎসা হতো। পরবর্তীতে সেটি প্রেসিডেন্সি জেনারেল হাসপাতালে রূপান্তরিত হয় যার নাম পিজি। প্রেসিডেন্সি হসপিটালের চিকিৎসা ব্যবস্থা সুবিদিত। রাজ্যের সর্বশ্রেষ্ঠ হাসপাতাল হিসেবে স্বীকৃত। এটির আর একটি নাম রয়েছে আইপিজিএমইআর– ইনস্টটিউট অফ পোস্ট গ্রাজুয়েট মেডিকেল এডুকেশন এন্ড রিসার্চ। এটি একটি সুপার স্পেশালিটি হাসপাতাল এবং জাতীয় গবেষণা প্রতিষ্ঠান।
১৯৫৪ সালে এর নাম হয় এসএসকেএম হাসপাতাল। শেঠ সুখলাল কারনানী ছিলেন কলকাতার একজন মহান দার্শনিক এবং ব্যক্তিত্ব। তাঁর সম্মানেই এই নামকরণ। উডবার্ণ ওয়ার্ড এই হাসপাতালের একটি বিশেষ ওয়ার্ড এবং এটি ভিআইপি ওয়ার্ড।সকলেই জানেন স্বনামধন্য ব্যক্তিত্বরা এখানে স্বাস্থ্য পরিষেবা পান। সাধারণ মানুষের সেখানে কোন স্থান নেই। এটি উদ্বোধন হয় ১৯০২ সালে।
উডবার্ণ কোন কাঠ পোড়ানোর বিষয় নয়,জন উডবার্ণ একজন উল্লেখযোগ্য ব্যক্তিত্ব। তিনি ছিলেন ব্রিটিশ শাসনকালে বাংলার লেফটেন্যান্ট গভর্নর। ১৯০০ এবং ১৯০১ এই দুই বছর তিনি এশিয়াটিক সোসাইটির প্রেসিডেন্ট ছিলেন। তিনি ছিলেন জলকল্যাণ ব্রতী শাসক। কলকাতার সেই প্লেগ মহামারীরকাল,যখন ভগিনী নিবেদিতা, চিকিৎসক আরজি কর ময়দানে নেমে পড়েছেন সেবার ব্রত নিয়ে, সেই সময়ে তিনিও এই মহামারী প্রতিরোধে তাদের সঙ্গে সহযোগিতা করেছিলেন তো বটেই সক্রিয় ভূমিকাও নিয়েছিলেন। গভর্নর হিসেবে তিনি স্বাস্থ্য পরিষেবার উপর বিশেষ নজরদারি করেন। তাঁর শাসনকালে এই পিজি হাসপাতালের আমূল সংস্কার সাধিত হয়। তাঁকে শ্রদ্ধা জানিয়ে এই উডবান ওয়ার্ড প্রতিষ্ঠা করা হয়। পরবর্তীতে যখন রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী জ্যোতি বসু তখন উডবার্ন ওয়ার্ডের নাম পরিবর্তন করে ডাক্তার এস এন ঘোষ– সুরেন্দ্রনাথ ঘোষের নামে নামকরণ করা হয়। কারণ ডাক্তার ঘোষ ছিলেন ডাক্তার ঘোষ ছিলেন এই হাসপাতালের প্রথম ভারতীয় চিকিৎসক। এই নামকরণ ছিল তাঁর প্রতি শ্রদ্ধার্ঘ্য নিবেদন।
রাজনৈতিক কারণে গ্রেপ্তারি এড়াতে বা আইনি জবাবদিহি এড়িয়ে যেতে ‘রাজনীতি করেখাওয়া’ তথাকথিত ক্ষমতাশীল নেতারা অসুস্থতার ভান করে এই ওয়ার্ডে ভর্তি হয়ে যাচ্ছেন। রাজনৈতিক হস্তক্ষেপে এবং চাপে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ নেতারা অসুস্থ– এই ‘মর্যাদা'(!) দিয়ে রিপোর্টও দিচ্ছেন। ফলত,এই মিথ্যার বেসাতিতে নিজেকে ও এই হাসপাতালকে অসম্মানিত করছেন?
হায় বাঙালি! শোনো এই হাসপাতালের ঐতিহ্য।
এই হাসপাতালেই মহাকবি মাইকেল মধুসূদন দত্ত রোগী হিসাবে শুশ্রূষার জন্য ভর্তি হয়েছিলেন ২২ জুন, ১৮৭৩ এবং এই হাসপাতালেই তিনি প্রয়াত হন।
এই হাসপাতালে গবেষণা করেই স্যার রোনাল্ড রস ম্যালেরিয়া রোগ জীবাণুর চক্র আবিষ্কার করেছিলেন এবং নোবেল পুরস্কার অর্জন করেছিলেন, সেটা ১৯০২ সাল।
এই এই হাসপাতালের প্রথম ভারতীয় চিকিৎসক ডাক্তার এস এন ঘোষ, তাঁর নাম পূর্বেই উল্লেখ করা হয়েছে।
সেটা ১৬ জানুয়ারি,১৯৫৭ সাল।এই হাসপাতালকে মেডিকেল রিসার্চ ইনস্টিটিউট হিসাবে উদ্বোধন করেছিলেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী জহরলাল নেহেরু।
প্রকৃতপক্ষে কার মুখ পুড়ছে? প্রশাসন কি এখনো আয়নায় নিজের মুখ দেখবে না? আন্তর্জাতিক ঐতিহ্য, জাতীয় উত্তরাধিকারের চেয়ে মার্কামারা রাজনীতির দলবাজি বড়?