অবতক খবর,২ অক্টোবর: হাজারো কর্মব্যস্ততা জীবন, দশটা পাঁচটায় চাকুরীজীবী কর্মরতপ্রিয় বাঙালি সমাজ। সেই গতিহীন মন্থর জীবনে যেনো হঠাৎ চলমান করবার প্রয়াস করে ফেলে বাঙালির রথযাত্রা উৎসব। বাঙালির মনে রথের দড়ির সাথে ঋতু পরিবর্তনের একটা সুষ্ঠু যোগাযোগ আছে। জগন্নাথ দেবের রথের দড়ির টানের সাথে বাংলা আকাশের বাতাসে প্রবেশ করে সেই শরতের হিমেল হাওয়া। বর্ষার সোদা গন্ধ খুঁজতে থাকে শরতের দুর্গোৎসবের গন্ধ কে। কয়েক জায়গায় বুনো ছাতিম ফুলের গন্ধ নেশাতুর করে তোলে। কচিকাঁচা থেকে পড়ন্ত কৈশোর সবাই খোঁজে বেড়ায় বিভিন্ন নামকরা দুর্গাপুজোর প্যান্ডেলের বাঁশ গুলো পড়েছে কিনা। শিয়ালদা মুখী অফিস বাবুদের হালিশহর স্টেশন পেরোলেই, নিজের অজান্তে ডান দিকে রেল ইয়ার্ড বা কোচ ফ্যাক্টরীর দূর দিগন্ত জুড়ে বিস্তৃত মাঠের দিকে চোখ পড়ে যায়। সাদা মেঘে ঢাকা কাশবন যেনো স্বর্গ থেকে এক বিস্তৃত সিঁড়ি নেমে এসেছে এই মাটিতে। নিমিষেই মুছে যায় সমস্ত চিন্তা, কষ্ট, সামাজিক চাপের বলি রেখা। নস্টালজিয়াতে ফিরে যায় মন, চেনা সেই শৈশবের আঙিনায়। এই বুঝি শুরু হয়ে গেল দুর্গোৎসবের ফিতে কাটা অনুষ্ঠান অর্থাৎ মহালয়া।
এই কলকাতার শহরতলীর অলিগলি সর্বদাই উৎসব প্রিয়। বাঙালি বারো মাসে তেরো পার্বণ থাকলেও মফস্বল এর মানুষ কিন্তু দুর্গাপুজোকে সমস্ত পার্বণের ঊর্ধ্বে রেখেছে। যেনো একটা সামাজিক বিপ্লব। কিন্তু এই একবিংশ শতাব্দীর রজত বর্ষের সান্নিধ্যে সত্যি কি মহালয়ার গুরুত্ব বাঙালির মনে কাজ করে? আমাদের কৈশরে মহালয়া বলতে এক অদ্ভুত আবেগ কাজ করত। প্রতিবার স্কুলের হাফ ইয়ারলি পরীক্ষা এই মহালয়ার আগে অথবা পরে শেষ হতো। আর সেই শিশুমনে মহালয়া উদযাপনের পরিকল্পনা প্রায় তিন চারদিন ধরে ঘুরপাক করত। কৈশরের শব্দবাজি এবং আলোক বাজি এগুলির প্রভাব মারাত্মিকভাবে পরিলক্ষিত হয়েছিল। ভোর সাড়ে তিনটের সময় উঠে ভালো জামা প্যান্ট পড়ে,এক হাতে ক্যাপ বন্দুক আরেক হাতে একটি ব্যাগের মধ্যে প্রচুর পরিমাণে বাজি নিয়ে সারা পাড়া পরিদর্শন। সেই সময় প্রত্যেকটি বাড়ির বয়োজ্যেষ্ঠরা সকালবেলা সিংহ দুয়ারে প্রদীপ ও ধুপ কাটি জ্বালিয়ে, দরজার সামনেটা জল দিয়ে ধোয়াতেন। ভোরের সেই ঠান্ডা মিষ্টি হাওয়া মনের মধ্যে তৈরি করতে এক অদ্ভুত রোমান্টিসিজম। মুখরিত শব্দবাজি বিভিন্ন ডেসিবেল এর বিভিন্ন আওয়াজ আর জানলা দিয়ে ভেসে আসা বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্রের শরতের আহ্বান। ভোর পাঁচটা থেকে ডিডি বাংলায় মহালয়া অনুষ্ঠান। সবশেষে বাবা কাকা জ্যাঠা তারা গঙ্গায় যেতেন তর্পনের উদ্দেশ্যে। এই ছিল মহালয়ার শৈশবের পাঁচালী। আজ মনে হয় ফিরে যাই সেই শৈশবে। জটিল জীবনের সিঁড়ি ভাঙ্গা অংকের থেকে বহু দূরে ,সরলতার বালখিল্যতায়। আধুনিকতার মেকি মোড়কে এই বর্তমানে এই দৃশ্য সত্যিই অপরিচিত। কিংবা বলা চলে বড্ড বেমানান।
মহালয়া আদতে একটি আনন্দের উপলক্ষ । যদিও এই দিনটির সাথে অনেক গল্প এবং লোককাহিনী জড়িত। দেবীমাহাত্ম্যম্ বা দেবীমাহাত্ম্য (সংস্কৃত: देवीमाहात्म्यम्) একটি হিন্দু ধর্মগ্রন্থ। এই গ্রন্থে মহিষাসুরকে পরাজিত করে দেবী দুর্গার(পার্বতীর কাত্যায়নী অবতার) বিজয়কাহিনি বর্ণিত হয়েছে। এই ধর্মগ্রন্থ চন্ডী পাঠ নামে পরিচিত। এখানে বর্ণিত, দেবী দুর্গা আনুষ্ঠানিকভাবে কৈলাস পর্বত থেকে তার যাত্রা শুরু করেন , যেখানে তিনি তার স্বামী ভগবান শিবের সাথে থাকেন। পৃথিবী তার মাতৃগৃহ। মহালয়া সংস্কৃত শব্দ থেকে এসেছে যার অর্থ “মহান আবাস”। কথিত আছে মহালয়ার দিন অসুর ও দেবতাদের মধ্যে সংঘর্ষ হয়েছিল। এই দিনই দেবী শপথ নেন মহিষাসুরকে বধ করার। মহালয়ার সাথে আরেকটি বিষয় জড়িত, যেটি হলো চক্ষুদান। এর একটি বিশেষ তাৎপর্য রয়েছে। মূর্তি কারিগররা ভোর চার টের সময় দেবীর সুন্দর চোখ আঁকেন এবং কারিগর সম্প্রদায়ের একজন প্রবীণ সদস্যকে মা দুর্গার চোখ আঁকার অনুমতি দেওয়া হয়। প্রথমে ত্রিনয়ন তারপর বাম চক্ষু সবশেষে ডান চক্ষু আঁকা হয়। এই একইভাবে মেয়ে লক্ষ্মী সরস্বতী গণেশ এবং কার্তিক সহ তাদের বাহনদেরও এই ভাবেই চক্ষুদান করা হয়। হিন্দু মতে এর সময় গহনা অর্থাৎ সোনা, রূপা, হীরে সহ অন্যান্য অলংকার না কেনার পরামর্শ দেয়া হয়। বাঙালি চুল নখ কিংবা সেভিং এই দিনটি এড়িয়ে যেতে চায়। লোকমুখে কথিত মহালয়ার দিন মুগ ডাল অবশ্যই রান্নার কাজে ব্যবহার করতে হবে ,পেঁয়াজ বা রসুন হিসেবে ধরা সবজি পরিত্যাগ করা উচিত।
মহালয়ার সাথে কর্ণের এক অক্ষয় যোগ আছে। কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধে মারা যাওয়ার পর কুন্তী পুত্র কর্ণ স্বর্গে গেলে, খাদ্য কিংবা পানীয়র বদলে তাকে শুধু সোনা রুপোর মত ধাতু খেতে দেয়া হয়। দেবতা যমের কাছে কর্ণের প্রশ্নের উত্তরে তাকে জানানো হয় যে তিনি আজীবন শক্তির আরাধনা করে গেছেন । কখনো পূর্বপুরুষের কথা স্মরণ করে তাদের আত্মাকে খাদ্য পানীয় দেননি। উত্তরে তিনি বলেন জন্মের সময় তারা মা কুন্তী তাকে পরিত্যাগ করেন। সূত বংশজাত অধিরথ এবং তার স্ত্রী তাকে পালন করেন। আশ্রয়দাতা দূর্যোধন তাকে কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধে অবতীর্ণ করলে, যুদ্ধের প্রথম দিন, প্রথমে কৃষ্ণ তারপরে মা কুন্তী এসে কর্ণের জন্ম ও বংশ পরিচয় জানিয়ে দেন। যুদ্ধের মাত্র ১৭ দিনের মাথায় তিনি মারা যান এবং স্বর্গে প্রবেশ করেন। তাই তিনি পিতৃপুরুষকে জল দেওয়ার সময় পাননি। যম (মতান্তরে ইন্দ্রের) নির্দেশে ভাদ্র মাসের কৃষ্ণ প্রতিপদ তিথিতে কর্ণ আবার মর্তে ফিরে এসে একপক্ষকাল থেকে পিতৃপুরুষকে তিল এবং জল দান করে পাপস্খলন করেন। আশ্বিনের অমাবস্যা তিথিতে শেষ জলদান করে কর্ণ স্বর্গে ফিরে যান। এই এক পক্ষকাল অর্থাৎ ১৫ দিন বাঙালি হিন্দু মতে পিতৃপক্ষ হিসেবে পরিচিত। মহর্ষি ব্রহ্মার নির্দেশে এক মিলনক্ষেত্র তৈরি করা হয় যেখানে পিতৃ পুরুষেরা এই ১৫ দিন পিতৃ লোক ছেড়ে মর্তে আসে তাদের সন্তানদের কাছ থেকে জল লাভের আশায়। পিতৃপক্ষের শেষ দিন অমাবস্যা টিকে মহালয়া হিসেবে ধরা হয়। পিতৃপক্ষ শেষে শুরু হয় দেবিপক্ষ। এবং তার সাথে বাদ্দি এবং আগমনী সুর বাজে।
প্রাগৈতিহাসিক যুগ থেকে মহালয়া প্রচলন হলেও এই দিনটিকে বরেণ্য এবং উচ্চ মার্গীয় সুরে যিনি বেঁধেছেন তিনি হলেন পঙ্কজ কুমার মল্লিক। রচনা এবং পরিচালনা হুগলির অন্যতম কৃতি সন্তান কাব্য সরস্বতী বাণীকুমারের। অবশ্যই বাণীকুমার নামটি ইন্ডিয়া বেতার কেন্দ্র থেকে উপাধি পাওয়া।আদতে তার নাম ছিল বৈদ্যনাথ ভট্টাচার্য।। রায় বাহাদুর বংশের অনামী বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্র কে করে বসলেন এক আবদার। করতে চান অনুষ্ঠান মহিষাসুরমর্দিনী। নাট্যকার বীরেন্দ্র কৃষ্ণ ভদ্র তখন ডুবে ছিলেন নাটকে। অনেক অনুরোধে তিনি শেষ পর্যন্ত রাজি হলেন। অবশ্য ১৯৩১ সালে প্রথমবার চণ্ডীপাঠ করেছিলেন স্বয়ং বাণী কুমার। পরবর্তীকালে চন্ডী পাঠের বিভিন্ন অংশ বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্রের গলায় সম্প্রচারিত হতে থাকে। কথিত আছে চণ্ডীপাঠ করার আগে বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্র গঙ্গায় গিয়ে স্নান করে মলিন বস্ত্র পরিধান করে আকাশবাণী কলকাতায় পৌঁছাতেন। ১৯৩৬ সাল থেকে সম্পূর্ণ যোগ পাঠ ও গ্রন্থনা করেন বীরেন্দ্রকৃষ্ণ। পরিচালনা করেন পঙ্কজ কুমার মল্লিক ও রাইচাঁদ বড়াল। রুদ্রবীণার মত আওয়াজ জন্ম জন্মান্তর ধরে হয়ে উঠেছিল বাঙালির নিজস্ব ভাষা। মাঝে ১৯৭৬ সালে উত্তম কুমারের স্টার ড্রাম দিয়ে একবার চ্যালেঞ্জ জানানো হয়েছিল বটে। বাঙালি সেদিন আকাশবাণী কলকাতার দরজার সামনে দাঁড়িয়ে ঐক্যবদ্ধভাবে প্রতিবাদ জানিয়েছিল। এমন এক প্রতিবাদ হয়েছিল যে ষষ্ঠীর দিনই পুনরায় সেই বীরেন্দ্র কৃষ্ণের গলার স্বর জাগিয়ে তুলতে হয়েছিল আকাশবাণী কলকাতাকে।
বাঙালির ঘরে এখন আর মহালয়ার ভোরবেলা রেডিও বাজে না। ইউটিউব ফেসবুকের দাপটে বর্তমানে ট্রামের মতো রেডিও বাতিলের খাতায়। অবশ্য আমাদের বাবা মা মহালয়ার আগের দিন সারা ঘর তন্ন তন্ন করে রেডিওটা খুঁজতেন। নতুন ব্যাটারি দিয়ে সেগুলোকে ঠিক করতেন। আগামী দিন মহালয়ার ভোরে দ্বিজেন মুখোপাধ্যায়ের “জাগো দুর্গা” আবার বেজে উঠবে। আল্লাদিত হবে বাঙালির হৃদয়। নবীন থেকে প্রবীণতর হয়ে যাওয়া মন গুলো আবার ফিরে যেতে চাইবে শৈশবের পথে। হাতরাতে থাকবে তার স্মৃতি। খুঁজতে থাকবে কোন এক শিউলি ভেজা মহালয়ার প্রারম্ভিক সময়। বেজে উঠবে শিপ্রা বসুর ওগো আমার আগমনী-আলো। আমরাও বলে উঠবো “জাগো মা”।