অবতক খবর / রঞ্জন ভরদ্বাজ :

অবতক খবর,১১ জুলাই: ব্যারাকপুর লোকসভা কেন্দ্রে এখন রাজনৈতিক চাপানউতোর চলছে। বিশেষ করে দুই দলের মধ্যে চলছে বাকবিতণ্ডা। অর্থাৎ অভিযোগ পাল্টা অভিযোগের পর্বের যেন শেষ নেই।‌এই লোকসভা কেন্দ্রে বিজেপি সাংসদ অর্জুন সিং-এর যেমন দাপট রয়েছে, অন্যদিকে ঠিক একইভাবে দণ্ডায়মান রয়েছেন তৃণমূল নেতা সুবোধ অধিকারী।

গত ২৩শে মে ২০১৯-এর পর বিজেপি যেভাবে তান্ডব চালিয়েছিল তা সকলেরই জানা। বাড়িঘর ভাঙচুর থেকে শুরু করে পার্টি অফিস দখল, বলতে গেলে মানুষের উপর অত্যাচার নামিয়ে এনেছিল এই দল। সেই সময়ে অনেকেই ভয়ে কোনঠাসা হয়ে গিয়েছিল। অর্থাৎ এই অত্যাচারের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর ক্ষমতা কারোর ছিল না বললেই চলে। গেরুয়া শিবির দাপিয়ে বেরিয়েছিল ব্যারাকপুর লোকসভা কেন্দ্র জুড়ে। মানুষের মধ্যে একটা ভয়, একটা আতঙ্ক তৈরি হয়েছিল যে আগামী দিনে আর কি কি হতে চলেছে। মানুষ ভাবতে বসেছিলেন যে, তারা কি আদেও পুরনো দিন আর ফিরে পাবেন! আর সেই সমস্ত ঘটনার সাক্ষী থেকেই মানুষ মুখ ফেরাতে শুরু করেছেন বিজেপি দল থেকে। ‌ আর যার কারণে এই ব্যারাকপুর লোকসভা কেন্দ্রে এত তান্ডব চলেছিল তার নেপথ্যে ছিলেন সাংসদ অর্জুন সিং। সেই সময় মার খেতে হয়েছিল প্রচুর পুরনো তৃণমূল নেতাকর্মীদের। ‌ কিন্তু সেই সময়ে তার পাল্টা দিতে পারেনি তৃণমূলীরা।
সেই সময়ে তৃণমূল সুপ্রিমো মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় থেকে শুরু করে তৃণমূলের যুবনেতা অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায় সহ অন্যান্য নেতারা ভাবতে বসেন যে এই গুন্ডা সাংদের হাত থেকে কিভাবে রক্ষা পাবে ব্যারাকপুর লোকসভা কেন্দ্র?
বীজপুর, নৈহাটি,ভাটপাড়া, ব্যারাকপুরে ক্রমাগত চলছিল তাণ্ডব।
কিন্তু কিছুই করতে পারছিলেন না পুলিশ প্রশাসন। তারা একপ্রকার নির্বিকার ছিলেন।
এই অত্যাচারের জেরে সেই সময়ে তৃণমূলের কিছু নেতাকর্মীরা প্রাণের ভয়ে যোগদান করেছিলেন বিজেপিতে। ‌ কাউকে মাথায় বন্দুক ঠেকিয়ে,আবার কারোর ঘরবাড়ি লুটপাট ও ভাংচুরের ভয় দেখিয়ে, তো কাউকে প্রলোভন দেখিয়ে বিজেপিতে যোগদান করানো হয়েছিল। ‌ এইভাবে প্রায় সকলকেই বিজেপিতে টেনে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। তৃণমূল কাউন্সিলর থেকে শুরু করে সাধারণ তৃণমূল কর্মীরা বিজেপিতে চলেই গিয়েছিল।
আর এই অত্যাচারের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে পারেনি কেউ, হাল ছেড়ে দিয়েছিল সকলেই।
ঠিক সেই সময় অর্থাৎ ১৪ই জুন ২০১৯,কাঁচরাপাড়ার মাটিতে পা রেখেছিলেন তৃণমূল দলের সুপ্রিমো তথা রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। ‌ আর তাঁর হাত ধরেই দায়িত্ব পেলেন সুবোধ অধিকারী। আর সেই সময় থেকেই মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের খুব কাছের হয়ে যান সুবোধ অধিকারী।

অন্যদিকে বিজেপি সাংসদ অর্জুন সিং-এর বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর ক্ষমতা প্রায় কারোর ছিলনা। সেই সময় থেকে দলে কার্যত বাদ পড়েছিলেন বিজেপির পুরনো কর্মীরা। ‌কারণ সাংসদ অর্জুন সিং যেহেতু তৃণমূল থেকে বিজেপিতে গিয়েছিলেন,সেই কারণে অর্জুন-এর পক্ষে যারা বরাবরই ছিল তারাই শুরু করে দেয় এই তান্ডব। সাংসদ অর্জুন সিং সেই সময় হয়তো ভুলে গিয়েছিলেন যে তিনি সাধারণ মানুষের দ্বারাই নির্বাচিত। কিন্তু সেই মানুষের উপর অত্যাচার নামিয়ে এনে শুরু করে দিয়েছিলেন এলাকা দখলের লড়াই।

কিন্তু তিনি যদি জনপ্রতিনিধি হয়েই জনগণের জন্য কাজ করতেন তবে আজকের তারিখ অর্থাৎ ১১ জুলাই পর্যন্ত তার সাথে যে ঘটনাগুলো ঘটেছে, তা হয়তো ঘটতো না। এখন তিনি গোটা ব্যারাকপুর লোকসভা কেন্দ্রে এমন একজন মানুষ খুঁজে পাচ্ছেন না যে তাঁর হয়ে প্রচার দেবে। কারণ মানুষ এখন তাঁর বিরুদ্ধে।
এ বিষয়ে বিজেপি দলের পুরোনো কর্মীরাই এখন বলছেন যে,২০১৮ সালে যখন রাজ্য সভাপতি দিলীপ ঘোষের উপর আক্রমণ হয় তখন দলের সকলে ঐক্যবদ্ধভাবে তার প্রতিবাদ করেছে, থানা ঘেরাও কর্মসূচি থেকে প্রতিবাদ মিছিল সবকিছু একসঙ্গে করেছে। কিন্তু এখন কোন ঘটনা ঘটলেও বিজেপির পুরনো কর্মীরা আর সেখানে নেই। অর্থাৎ কোন প্রতিবাদে নেই। তিনি এখন শুধু পাচ্ছেন‌ হাতেগোনা কিছু মানুষকেই। তিনি ব্যারাকপুর অঞ্চলে পাচ্ছেন মনীষ শুক্লাকে, নোয়াপাড়ায় পাচ্ছেন সুনীল সিং-কে, জগদ্দলে পাচ্ছেন সৌরভ সিং-কে, ভাটপাড়ায় তিনি পাচ্ছেন পবন সিং-কে, নৈহাটিতে তিনি পাচ্ছেন গণেশ দাসকে এবং বীজপুরে তিনি পাচ্ছেন শুভ্রাংশু রায়কে।
কিন্তু বীজপুরের ক্ষেত্রে শুভ্রাংশু রায়কেও তেমন সক্রিয়ভাবে দেখা যাচ্ছে না। কারণ তিনি নিজে কি করবেন আর কি করবেন না তা তিনি নিজেই সিদ্ধান্ত নিতে পারছেন না। ব্যারাকপুরের সাতটি বিধানসভায় হাতেগোনা কয়েকজন ছাড়া তাঁর হয়ে প্রচার দেওয়া বা তাঁর সাথে যে ঘটনাগুলি ঘটছে সেই নিয়ে সরব হওয়ার কেউই নেই।

কিন্তু ১৪ই জুন ২০১৯ থেকে ১০ই জুলাই ২০২০ এই সময়কালের মধ্যে তৃণমূল নেতা সুবোধ অধিকারী সাংসদ অর্জুন সিং-এর পায়ের তলার জমিটাই নড়বড়ে করে দিয়েছেন।
যে অর্জুনের নামে গোটা এলাকা সন্ত্রস্ত ছিল, কিন্তু আজকের তারিখে দাঁড়িয়ে দেখা যাচ্ছে তাঁর পাড়ার একটা ছেলে ছোকরা পর্যন্ত অর্জুন সিং-এর বিরুদ্ধে মুখ খুলছে।

আর মানুষ বলছেন, এর পুরো কৃতিত্বই তৃণমূল নেতা সুবোধ অধিকারীর।

মানুষ জানাচ্ছেন, এখন ব্যারাকপুর লোকসভা কেন্দ্রের রাজনৈতিক ক্ষেত্রে চাণক্য হলেন সুবোধ অধিকারী।
কারণ তিনি যেভাবে একের পর এক পৌরসভা, পার্টি অফিস সব তৃণমূলের ফিরিয়ে আনতে পেরেছেন। আর সবথেকে বড় বিষয় হল তিনি মানুষের পাশে দাঁড়িয়েছেন। ‌ মানুষকে সাহস যুগিয়েছেন।তিনি মানুষকে আশ্বাস দিয়েছেন যে, গুন্ডা সাংসদ অর্জুন সিং বা তাঁর গুন্ডাবাহিনীকে ভয় পাওয়ার আর কোন কারণ নেই।

তিনি আরো বলেন, মানুষ আতঙ্কিত হবেন না কেন? কারণ সাংসদ অর্জুন সিং যেখানেই গেছেন সন্ত্রাস ছড়িয়েছেন, তাঁর গুন্ডা বাহিনীকে উস্কে দিয়েছেন সন্ত্রাস ছড়াতে। আপনাদের হয়তো মনে আছে তিনি একসময় জয় শ্রীরাম নাম শুনলেই গালিগালাজ করতেন। ‌ আর এখন তাঁর মুখেই জয় শ্রীরাম। কারণ তিনি নিজের স্বার্থ ছাড়া আর কাউকে চেনেন না।
২০১৯-এর লোকসভা নির্বাচনে তিনি ভাগ্যক্রমে জিতে গিয়েছেন। কিন্তু এবার বিধানসভা নির্বাচনে তিনি কোথায় থাকেন সেটাই দেখার। হয়তো রাজনীতি থেকে তিনি অনেকটাই দূরে চলে যাবেন। ‌ কারণ তিনি পরিবার তন্ত্রে বিশ্বাসী। পরিবার নিয়েই রাজনীতি করছেন তিনি।
তিনি ঠিক করে রেখেছেন যে তিনি ব্যারাকপুরে সুধা সিংহকে দেবেন, নোয়াপাড়ায় থাকবেন সুনীল সিং, জগদ্দলে সৌরভ সিং, ভাটপাড়ায় পবন সিং, নৈহাটিতে গণেশ দাস এবং বীজপুরে তার অনুগামী শুভ্রাংশু রায়। কিন্তু দলে যারা পুরনো কর্মী, যারা এত লড়াই করে বিজেপিকে নিয়ে এসেছিল তিনি আজ তাদের কথা ভাবছেনই না। যেই বিজেপি কর্মীদের একসময় তিনি মেরেছিলেন, এখন সেই বিজেপি দলের হয়ে তাদেরকেই দেখছেন না। ‌৮ জুলাই, ২০২০-তে ভাটপাড়ায় যেখানে অর্জুন সিং নিজে সবসময় কাউন্সিলর পদপ্রার্থী হিসেবে দাঁড়িয়েছেন, অর্থাৎ ভাটপাড়া ১৭ নং ওয়ার্ড,সেখানেই এদিন সমস্ত বিজেপি সমর্থকরা তৃণমূলে যোগদান করেছেন। যেসব কর্মীরা যোগদান করেছেন তারা বলছেন বিজেপিতে গিয়ে জয় শ্রীরাম ছাড়া ছাড়া আর কিছুই পাননি।
ভাটপাড়া থেকে শুরু করে বীজপুর এমনকি গোটা ব্যারাকপুর লোকসভা কেন্দ্রে সুবোধ অধিকারী এখন এমন একজন নেতা হয়ে দাঁড়িয়েছেন যে, দাপুটে নেতারা তাঁকে সমঝে চলছেন। কারণ তিনি মানুষের সমর্থন পাচ্ছেন এবং পাশে পাচ্ছেন তৃণমূল কর্মীদের।

অর্থাৎ বোঝাই যাচ্ছে আসন্ন নির্বাচনে বিজেপি ব্যারাকপুর লোকসভা থেকে বিদায় নিতে চলেছে। এমনই বললেন তৃণমূল নেতা সুবোধ অধিকারী।