ভাঙা আয়না
তমাল সাহা

আয়না নিয়ে অনেক কবিতা গল্প আছে।
মায়ের আমল থেকে আমাদের বাড়িতে ছোট্ট একটি সরু কাঠের ফ্রেমে বাঁধানো ভাঙা আয়না ঠাকুর ঘরের দেয়ালে ঝুলানো আছে।

মা বলতো, শুধু দুবেলা আয়নায় মুখ দেখতে হয়। বারবার দেখলে মুখের মহিমা কমে যায়।
তোর ঠাকুমা এই ভাঙা আয়নাটি আমার হাতে দিয়ে বলেছিল, বৌমা এটা তিন পুরুষের আয়না। আমার হাতেও ভাঙা অবস্থায় তুলে দেয়া হয়েছিল। তুমি এটা সযত্নে রেখো।

আমার মা সকালবেলা স্নান সেরে ঠাকুর ঘরে ঢুকে সেই আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে কপালের মাঝখানে একটা বড় গোলাকার টিপ আর সিঁথিতে লম্বা করে সিঁদুর দিতো।
সারাদিনের শ্রমের পর সাফসুতরো হয়ে সন্ধ্যেবেলা আবার সেই সিঁদুর নিয়ে খেলা। তারপর তুলসী থান, সন্ধ্যাপ্রদীপ, ধূপবাতি, গলায় আঁচল জড়িয়ে প্রণাম।

ভাঙা আয়নায় কি মুখ দেখা যায়?
আমার মা বলতো,
আয়নায় নারীরা মুখ দেখবে কেন?
তারা তো দেখবে তাদের কপালে আর সিঁথিতে ঠিক জায়গায় সিঁদুর পড়ছে কিনা।
আমার মুখ তো দেখবে তোর বাবা। আয়না আমার মুখ দেখবে কেন?

আমিও ঠাকুর ঘরে আয়নার সামনে রোজ সকালে এবং বিকেলে দাঁড়াই। কিছুই করি না, শুধু ভাঙা আয়নায় নিজের টুকরো টুকরো চেহারাটি দেখি।

তারপর রাস্তায় বেরিয়ে পড়ি।
ভিড় বহুল জায়গায় মানুষের মুখ দেখি।
বস্তিতে ইটভাটাতে সতীমার মেলায় শ্মশান খোলায় মানুষের মুখ দেখি।
প্রত্যেক মানুষের মুখের আয়নায় নিজের অনুভবটি দেখতে পাই।

মাটি জল আগুনের পাশ দিয়ে আমি হাঁটতে থাকি একটি বিশাল আভাঙা আয়নার খোঁজে,যেখানে সূর্যের আলোয় উজ্জ্বল হয়ে উঠবে সমস্ত মানুষের মুখ।