ভাবসম্প্রসারণ
তমাল সাহা
“করোনা ভয় করোনা”।
ক্লাসে ঢুকেই দিদিমণি চক দিয়ে বড় বড় করে লিখলেন বাক্যটি ব্ল্যাকবোর্ডের ওপর। তার ওপরে মুখে বলতে বলতে লিখলেন, এটিভাব সম্প্রসারণ করো।
টুকুন বাক্যটির অর্থ অনুধাবন করে উপলব্ধে আনলো এবং তৎক্ষণাৎ বসার সিট থেকে উঠে দাঁড়িয়ে বলল,
— দিদিমণি! এটা ভাবসম্প্রসারণ হবে না রচনা হবে। রীতিমতো প্রবন্ধ হবে।
দিদিমণি বলেন
— কেন? হবে না কেন টুকুন!
টুকুন বলে,
— দিদিমণি! প্রচার শুনে শুনে ভাব কতটুকু আসে। ভাব সম্প্রসারণ তো বোধির উচ্চারণ। এটা প্রবন্ধ হলেই ভালো হয়। এটা বিশ্বব্যাপী এক মহামারি, প্রাকৃতিক বিপর্যয়। এটি একটি জাগতিক ঐতিহাসিক ঘটনা হয়ে থাকবে। এটির ভাব শুধু সম্প্রসারিত করলেই হবে না, এটা প্রবন্ধ আকারে পৌঁছে দিতে হবে মানুষের কাছে। এটা তো শুধু শারীরিক আক্রমণ নয়, এতে জড়িয়ে আছে সামাজিক, অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক বিষয়, ক্রিয়া এবং প্রতিক্রিয়া। একে আমাদের ক্লাস ফোরের রচনার মতো বিভিন্ন ভাগে ভাগ করে বিশদভাবে লিখতে হবে। যেমন–ভূমিকা, আকৃতি, প্রকৃতি, ক্রিয়া, প্রতিক্রিয়া, উপসংহার– এই দৃষ্টিভঙ্গিতে লিখে মানুষের মধ্যে পৌঁছে দিতে হবে।
দিদিমণি জানতে চাইলেন,
কেমন?
টুকুন তো থামতেই চায় না।
সে বলে,
— রোগটি ভাইরাসজনিত। কিভাবে এলো? কেন এর নাম কোভিড–এন কোভিড ১৯? কিভাবে বিস্তার? তাতো বিস্তারিত লিখতে হবে। লিখতে হবে লকডাউন মানে কি? স্যানিটাইজেশন কি? কোয়ারান্টাইনে ১৪ দিন থাকতে হয় কেন? হটস্পট, রেডজোন কি? কেন মাস্ক, গ্লাভস? কেন কোভিড কিট? এসব লিখতে হবে ইন ডিটেইল।
দিদিমণি রীতিমতো উত্তেজিত। মেয়েটি এতো ভেবেছে! আর কি কি লিখতে হবে, বল?
টুকুন বলে,
লিখতে হবে রোগ নিরাময়ে সরকারি গাফিলতি, নার্সদের বিক্ষোভ, চিকিৎসকদের প্রতিক্রিয়া, তাদের জীবনের ঝুঁকির কথা। এমনকি সরকারের বিরুদ্ধে বিক্ষোভের কথাও।
সামাজিক বিষয়টি তো বিশদভাবে লিখতে হবে। অসংগঠিত শ্রমিকরা দেশে থেকে কেন পরিযায়ী? লকডাউনের আক্রমণে তাদের কি সর্বনাশ হয়েছে। কর্মস্থল থেকে তাদের ছাঁটাই। ভুখাপেটে তাদের শতশত মাইল লংমার্চ! চলমান পথে সড়কে ট্রাকে, লরিতে ধাক্কায় তাদের মৃত্যু। রেলপথ ধরে পালিয়ে হাঁটায় ট্রেন চাপায় মৃত্যু। মৃতদের দেহ—রক্ত, মাংস, অভক্ষ্য রুটি একাকার।
দিদিমণি! আপনি বলছেন এর পরেও এটা ভাবসম্প্রসারণ হবে?
বারবার হাত ধোও রে! গরীব বারবার হাত ধোবে কি করে? কে জোগাবে তার সাবান, স্যানিটাইজার?
মুখোশ পরো রে! কে দেবে তাকে মাস্ক?
সামাজিক দূরত্ব, সোশ্যাল ডিস্ট্যান্সিং বিধি মেনে পেটের দানাপানি যাকে বলছেন আপনারা ত্রাণ সামগ্রী। ভিক্ষের দান নাও, অন্যদিকে নিজের চোখের সামনে গরিবদের খিদের চাল চোরদের দেখো! দেখো নেতাদের কামাইবাজির কারবার! বিবেক, মূল্যবোধ লুপ্ত। আপনি বলছেন ভাব সম্প্রসারণ?
দিন মজুরের উপার্জন বন্ধ। নেতাদের মিথ্যে ভাষণ। মন্ত্রীদের গাল ফোলানো বক্তব্য। এসব লিখতে হবে না? লিখতে হবে না, সাধারণ মানুষের অর্থনৈতিক বিপন্নতার কথা? ভাব সম্প্রসারণে এই সম্পূর্ণ চিত্র ধরা যাবে?
করোনা একটা অঙ্ক দিদিমণি!
দিদিমণি আঁতকে ওঠে।
করোনা কিভাবে অঙ্ক? মানে?
টুকুন বলে, কোভিড টেস্ট কমছে, মৃত্যুর সংখ্যা বাড়ছে। স্বাভাবিকভাবেই এটা ব্যস্তানুপাতিক সম্পর্ক। এ তো নিশ্চিত অঙ্ক! আর মৃত্যুর সংখ্যা নিয়ে জালিয়াতি, জুমলা। একে আপনি কি বলবেন? মর্গ থেকে লাশ গায়েব! একে আপনি কি বলবেন?
করোনা ত্রাণ বন্টনে একটা রাজনৈতিক সম্পর্ক আছে। এর মধ্য দিয়ে ভোটের প্রচার চলছে। মহান নেতা নেত্রীদের ছবি দিয়ে ত্রাণ সামগ্রী বন্টনের প্যাকেট তৈরি করা হচ্ছে। খাদ্য বিতরণে দলবাজি, এ তো মানুষের অমর্যাদা! মানবতার অপমান!
ও বলছে ত্রাণ দেবো আমি ছ মাস! এ বলছে আমি ত্রাণ দেবো এক বছর।
কিন্তু করোনা থেকে মুক্তি পাবার উপায় কেউ বলছে না। কেন? কেন? তার পরেও এটা ভাব সম্প্রসারণ থাকে দিদিমণি!