তাঁর জন্মদিন নিয়ে ধন্দ আছে। গুগল বলছে,১ জানুয়ারি, ১৯২৮। লাল সংবাদ জানাচ্ছে স্কুল রেজিস্টারে লেখা আছে ১০ জুলাই ১৯৩০।
নকশাল নেতা তরাইয়ে কৃষক বিদ্রোহের অন্যতম সেনাপতি কানু সান্যালের সঙ্গে মুখোমুখি দেখা
ভাবো, ভাবা প্র্যাক্টিস করো
তমাল সাহা
তমুর মনে পড়ে গেল ঋত্বিক ঘটকের কথা– ভাবো, ভাবা প্র্যাক্টিস করো। কি ভাববে তমু? রাজনীতি? না লেখালেখি? কত ইচ্ছে যে তমুর!
তমু রাজনীতি ভালোবাসতো এটা সঠিক। বামপন্থী রাজনীতি, বিপ্লব এসব নিশ্চিত মস্তিষ্কে অক্সিজেন জোগাতো। পরে তো রীতিমতো সান্ধ্য আইন জারি করলো। তার শুধু মায়েদের মুখ ভেসে উঠতো। যেখানে জমি জোতের লড়াই, সেখানেই নারীরা কেন? এসব প্রশ্ন তার মাথায় উঠতো। তেভাগায় অহল্যারা, তরাইয়ে ধনেশ্বরীরা, তেলেঙ্গানায় মেয়েরা। উদ্বাস্তু অর্থাৎ বাস্তুভিটে, সেই জমি হারানোর আন্দোলনে নারীরা– সে তো এসব পড়েছে, দেখেছেও। কৃষকসভার জমায়েতে মেয়েদের মুখ অনেকবার সে দেখেছে। ধনেশ্বরী দেবীকে তার মা বলে ডেকে উঠতে ইচ্ছে করলো।
মা শব্দটি তার মাথায় খেলতে লাগলো। মা- মাটি। মা-ও জন্ম দেয়, মাটিও জন্ম দেয়। মাটি তো নারী। মা গর্ভবতী না হলে মানুষ জন্মায় না। মাটি গর্ভিণী না হলে শস্য জন্মায় না। মা স্তন দেয়। মাটি দেয় ধানের ভিতর ঘনীভূত দুধ। দুটো রঙই সাদা। মৃত্তিকা শব্দটি তার খুব পছন্দ। কোনো নারীর নাম যদি হতো মৃত্তিকা, সে তাহলে তাকে খুব ভালোবাসতো। আসলে মানুষ তো মৃদঙ্গ। মৃদঙ্গ বেজে ওঠে। মৃদঙ্গ বাজতে বাজতে সুরধ্বনি বাতাসে বয়ে যায়। মৃত অঙ্গ, মৃৎ অঙ্গ-মৃদঙ্গ হয়েই তো মাটিতে মেশে, ইন্তেকালে চলে যায়।
মাটির সঙ্গে তখন রাজনীতির সম্পর্ক আলোচনা হচ্ছে। কৃষক আন্দোলন গুরুত্ব পাচ্ছে। কী করবে তমু? নকশালবাড়ির ঘটনার পর কলকাতায় বিভিন্ন স্তরে আলোড়ন তৈরি হয়েছে। সরকার যুক্তফ্রন্টের হাতে। সুতরাং লড়াইয়ের সুযোগ এসে গিয়েছে। উৎপল দত্ত, তাপস সেন, হেমাঙ্গ বিশ্বাস, বিভিন্ন সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রের মানুষরাও ভাবছেন– তমু এসব নজরে রাখছে।
সেই শব্দ দুটি তখনই তমু শিখলো এবং বুঝতে চেষ্টা করলো– সংশোধনবাদী ও নয়া সংশোধনবাদী। ১৯৬৬ সাল, সেই ঐতিহাসিক সাইকেল মিছিল। সিপিএম- এর জগদীশ দাস বনাম কংগ্রেসেের বীজেশ সেনের নির্বাচনী লড়াই। সে এক উন্মাদনা। হালিসহর বলদেঘাটায় কংগ্রেসীদের দ্বারা মিছিল আক্রান্ত। তারপর মুখোমুখি সংঘর্ষ। কাঁচরাপাড়া রেল হাসপাতালে আহত ব্যান্ডেজ বাঁধা বীজেশ সেন– লোকদেখানো নাটকীয় ভূমিকায় অবতীর্ণ হলেন। তার আগে মিছিল ভেঙে ছত্রাকার। আক্রমণের জেরে সাইকেল ফেলে পালানোর সে এক মরণ বাঁচন দৃশ্য। পার্টি তো জিতলো। ১৯৬৭ সাল। সেই চরম মুহূর্ত। পার্টি কোন পথে যাবে? সংসদীয় রাস্তা নাকি সশস্ত্র বিপ্লবের পথ? চারু মজুমদার নামটি চলে এলো দৃষ্টিপথের মধ্যে। চলে এলেন কানু সান্যাল,জঙ্গল সাঁওতাল প্রমুখ। ছিলেন কৃষ্ণ কুমার সান্যাল হয়ে গেলেন কানু সান্যাল।আমার বন্ধু রঞ্জন, সীতেশরা ততদিনে অন্যদিকের ভাবনা শুরু করে দিয়েছে। অন্য পথ, অন্য ধারা।
তারপর ঘটে গেল সেই ঐতিহাসিক রণধ্বনি ২৪ মে, ১৯৬৭। জেগে উঠলো নকশাল বাড়ির কৃষকরমণীরা। পুলিশ অভিযানের প্রত্যুত্তরে রুখে দাঁড়ালো কৃষক। তার সে সাবেকি অস্ত্র নিয়ে। তীরন্দাজী কৃষকের তীরে নিহত হলেন পুলিশ ইন্সপেক্টর সোনম ওয়াংদি। পরদিন সেই এগারো জনের শহিদ হয়ে যাওয়ার ঘটনা ইতিহাস হয়ে গেল। নকশালবাড়ির কৃষক আন্দোলন। কানু সান্যাল ছিলেন নেতৃত্বে। তামাম ভারতবর্ষের চোখ তখন কানু সান্যালের দিকে।
নকশালবাড়ি ও নকশাল শব্দ দুটি আন্তর্জাতিক হয়ে উঠলো। ইংরেজি ও বাংলা অভিধানে ঢুকে গেল। নতুন চেতনায় জেগে উঠলো ভারতবর্ষ। কৃষক লুঠ করে কেড়ে নিল পুলিশের বন্দুক। জোতদারের বিরুদ্ধে চলল লড়াই। ভূমি ও রাজস্ব মন্ত্রী হরেকৃষ্ণ কোঙারের সঙ্গে বৈঠক হলো কানু সান্যালের কিন্তু তাকে টলানো গেল না।
লম্বা কালো মোটা ফ্রেমে বাঁধানো চশমাওয়ালা মানুষটির নাম জেনে গেল দুনিয়ার শ্রমজীবী মেহনতী মানুষ। কানু সান্যালরা নয়া সংশোধনবাদীদের লাইন ভেঙে তছনছ করে জন্ম দিতে চলেছেন নতুন পার্টি।
কাঁচরাপাড়ায়ও চাপা উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়লো। তখনকার সিপিএমের সদস্য ও প্রয়াত কয়েকজন সদস্য ভাবনা চিন্তা শুরু করেছিলেন। কলকাতা থেকে আগত নকশাল নেতা নির্মল ব্রহ্মচারী সহ কয়েকজন নেতা সিটিবাজার অঞ্চলে গোপন রাজনৈতিক বিতর্ক ও আলোচনায় এসেছিলেন। সে এখন স্মৃতির আলোকে বিস্মৃতির কথা।
তারপর দেখা হল তার সঙ্গে তমুর। মে দিবসের রক্ত পতাকা এবং পলাশ শিমূলের রঙ একাকার হয়ে গেছে। তমুরা উৎসুক দেখবে তাকে।
১ লা মে, ১৯৬৯। দেখা হলো তার সঙ্গে শহিদ মিনারে। সেই শহিদ মিনার। কানু সান্যাল, সেই দুরন্ত, দুর্ধর্ষ দীর্ঘকায় মানুষ। সেই সাদা শার্ট, সাদা ধুতির মধ্যে ঠিকরে বেরিয়ে আসছে দুটি বিশাল চোখ। হাতে রেড বুক। ঘোষণা করলেন ভারতবর্ষের নতুন কমিউনিস্ট পার্টির জন্মের কথা৷ সি পি আই( এম এল)। তমুরা শুনতে পেল তার কন্ঠ। প্রত্যক্ষ করলো মানুষটিকে।
ততদিনে তমুরাও পড়ে ফেলেছে রেড বুক। বুকের রক্তে লেগে থাকে যে বই তাকেই তো বলে রেড বুক। আর সেদিনের পার্টি প্রতিষ্ঠার ঘোষণার সঙ্গে মুহুর্মুহু বোমা বিস্ফোরণের ঘটনা প্রথম পাতার সংবাদ হয়ে প্রকাশিত হল আনন্দবাজার পত্রিকায়। এ যেন শুভ সূচনার মাঙ্গলিক ধ্বনি।
এই মানুষটির স্মৃতি চারণায় মনন শুদ্ধ হয়, তার স্মরণে মাথা নীচু হয়ে আসে। তিনি পায়ে হেঁটে চীন গিয়ে বিপ্লবী নেতা, লঙ মার্চের নেতা ‘চীনের চেয়ারম্যান আমাদের চেয়ারম্যান’ মাওসেতুং-এর সঙ্গে দেখা করেছেন, কথা বলেছেন সেই বয়সে তমুর কাছে সেটা ছিল দারুণ উত্তেজনাকর বিষয়!
আর সেই দেয়াল লিখনটি ‘ শ্রীকাকুলাম ইয়েনান হয়ে গেছে’ — মুক্ত ঘাঁটি,যেন একটা বিশাল বিজয়!
কানু সান্যাল বিশাখাপত্তনমে গ্রেপ্তার হলেন।
পার্টির নামে এই ধান্দাবাজির সময়ে সরকারি ভাবে চিকিৎসার সুবিধাকে তিনি দৃঢ়তার সঙ্গে প্রত্যাখ্যান করে অসুস্থ জীবনের প্রান্তিকে বলেছিলেন — না এখন আর কমিউনিস্টরা কমিউনে থাকেন না। তিনি থাকতেন বাঁশের তৈরি একটা ছোট্ট ঘরে। মেঝেতে পাতা থাকতো ছেঁড়া চাটাই। তিনি তাতে শুতেন। পাশে থাকতো একটি টর্চ। দেয়ালে ঝোলানো থাকতো মার্ক্স, এঙ্গেলস, লেনিন, স্টালিন, মাও সে তুং এর ছবি।
চা শ্রমিক মহল্লায় আজীবন কাজ করে গেলেন। তিনি চলে গেলেন ২৩ মার্চ ২০১০। কী খেতেন কানু সান্যাল? কে জানে?
পার্টি, পার্টি আর পার্টি! একটি সাচ্চা কমিউনিস্ট পার্টির সঙ্গে প্রেম করে আমৃত্যু লড়াকু থাকবেন এই ছিল তার একমাত্র লক্ষ্য এবং ইচ্ছা।
শেষবেলায় তার ঘরে চাটাই মাদুরের উপর পড়েছিল শুধু মার্কস, লেনিন, মাওসেতুং-এর লেখা বইগুলি।
এই লেখা লিখতে গিয়ে তমুর কেন কান্না পাচ্ছে তমু জানে না। হয়তো তমু মধ্যবিত্ত চেতনার মানুষ, এ ছাড়া আর কি কারণ থাকতে পারে?
তমু বুঝেছে কমিউনিস্ট হওয়া খুব ভালো, কিন্তু কঠিন এ জীবন!