মণ্ডপ
তমাল সাহা

তখন ইজের পরতুম।নন্দীবাড়ির পুজো মণ্ডপে অপলক চোখে ঠাকুর প্রতিমা গড়া দেখতুম। তখন জানতুম মণ্ডপকে দুর্গা দালান বা ঠাকুর দালান বলে, মা আমাকে এই শব্দ দুটি শিখিয়েছিল।
মণ্ডপ মানেই মন কেমন করা অন্য এক স্থাপত্য। পঙ্খের কারুকাজ। কর্ণিক বাশুলি হাতে রাজমিস্ত্রিদের শ্রমনিপুণ ওস্তাগরি। স্থাপত্য শব্দটা বড় হয়ে শুনি। যিনি শৈলীতে সৌন্দর্য স্থাপন করতে পারেন তিনিই স্থপতি। হাতের নৈপূণ্য কারিগরি-ই স্থাপত্য।
নস্টালজিয়ায় আক্রান্ত স্থাপত্য মানে কি? আমার মননে স্থাপত্যের ঘুলঘুলিতে কবুতরের বকবকম জোড়া পায়রা। তারপর পায়রাদের ওইসব! একের উপর একজন সওয়ারি।পশু পাখিদের মধ্যে পুরুষরাই তো বেশি সুন্দর! মোরগের দীর্ঘতা,লাল ঝুঁটি-চিকন সবুজ কালোপালক, পায়রার গাত্রবর্ণ বকবকম শব্দ, সিংহের কেশর, ময়ূরের পেখম তো তাই বলে!

বাঘওলা বাড়ির লোকেরা বড়লোক। বড়লোকের বাড়িতেই দুর্গাপুজো হয় এমনই জানতুম। পাড়ায় অবশ্য আলোক সমিতির মাঠে সতীশ নন্দী রোডে দুর্গাপুজো হতো। ঠাকুর বানাতেন দীর্ঘদেহী ঝাঁকড়া চুলওয়ালা পেটানো শরীরের রেল কারখানার এক কামগার যাকে বলা হতো এ অঞ্চলের মড়াপোড়ানোর মাস্টার সেই নদীয়ার চাঁদ সরকার।

অদ্ভুত সব বিষয়! আমি পড়তুম সতীশ নন্দী প্রাথমিক বিদ্যালয়ে। এটা আবার সতীশ নন্দী তৈরি করে দিয়ে গিয়েছিলেন। তখনকার দিনে ধানকলের মালিক ছিলেন এরা। এই নন্দী বাড়িতে এখনো দুর্গাপুজো হয়, কুমারী পুজো হয়। আমি নেমন্তন্ন পাই। দশমীর দিন পাতপেড়ে খাওয়ানো হয়। মাতৃপ্রতিমা বাহকদের কাঁধে চেপে দুলকি চালে, ভাগীরথী পারে চলে যায়। সরে যাও, সরে যাও,রাস্তা করে দাও গো! নন্দীবাড়ির ঠাকুর আসছে গো!
পাঠশালায় জল তেষ্টা পেলে মাস্টার মশাইদের কাছে উঠে দাঁড়িয়ে বলতে হতো, তেষ্টা পেয়েছে স্যার! তারপর অনুমোদন পেলে ছুটে যেতে হতো বাঘওলার নন্দী বাড়ি। এদের বাড়ির বড়লোকেরা জনকল্যাণে এই জনপদে অনেক কাজ করে গিয়েছেন। শিবানী হাসপাতাল, মাতৃসদন– এসব নির্মাণের মূলে তারা ছিলেন।
তখন বাঘওলা বাড়িতে পৌরকলের পানীয় জলের মানে স্বাস্থ্যবান জলের ব্যবস্থা ছিল। আমরা সেখানে চলে যেতুম‌ জল পান করতে। স্কুলে তখন জলের কল বা কলের জল ছিল না। বড় একটা মাটির কলসি টাইপের হাঁড়িতে পানীয় জল রাখা হতো। পুজোর সময়ে আমার ঘনঘন জল তেষ্টা পেতো। এক ছুটে চলে যেতুম নন্দী বাড়ি। তাদের মন্দির চত্বরের রেলিংয়ে ডান হাতের তেলোর ভরে থুতনি ঠেকিয়ে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে মণ্ডপে ঠাকুর গড়া দেখতুম।

আদি অর্থে মণ্ডপানের স্থানকে মণ্ডপ বলে। সেই মণ্ডপ হয়ে গেল চাঁদোয়া বা সামিয়ানা টাঙানো জায়গা। তার থেকে নাটমন্দির। কেউ বলে জগমোহন। মণ্ডপ এইসব শব্দের মাত্রা পেল এবং দেব দেবীর পুজোর উৎসবে জড়িয়ে গেল। শেষ পর্যন্ত তা হয়ে দাঁড়ালো প্যান্ডেল।

প্যান্ডেল মানেই পুজো প্রেম। যখন শরীরে সেই রসায়নের আগম ঘটলো তখন আমরা সকাল থেকে দুপুরের একটা সময় পর্যন্ত আবার সন্ধ্যে লাগতেই প্যান্ডেলের এক কোণে আড্ডা দিতুম। সেই আড্ডা নিশ্চিত ভাবে বাস্তব জীবন গড়ার বৈঠকী আড্ডা। পুজোর প্যান্ডেলে বসেই আমাদের সিগারেট খাওয়া শেখা এবং ঘন ঘন চা পান। তোমরা যাই বলো প্যান্ডেল আর পুজোর একটা আলাদা দাম মানে আমার কাছে ঐশ্বর্য আছে। প্যান্ডেল মানেই মৃন্ময়ী মাকে দেখা আর চিন্ময়ী সব নারীদের দেখা, যারা…
যারা মানে? যারা প্রেমিকা হতে পারে, পরে একেবারে বাস্তবের সম্পূর্ণ চিন্ময়ী মূর্তি হয়ে উঠবে। এসব ভাবনার একটা আলাদা সুখের অনুভব আছে। তখন তো দেখার সুখের বোধ স্নায়ুতে তৈরি হয়ে গেছে। তারপর এল কথা বলার সংবেদনশীল সুখ। তারপর? তারপর তো গোপন স্পর্শ সুখ। প্যান্ডেলের সামনে আলো, পিছনে সেই জমকালো! দুজোড়া ঠোঁট জোছনার আলোকে পিছনে ফেলে দিয়ে হঠাৎ করে চমকালো!

এই ছিল শুধু? এছাড়া ছিল হৃদয়ের বারুদ ঘর শারদ সংখ্যা প্রকাশের আলোচনা, বিভিন্ন শারদ সংখ্যা পাঠের অনুভূতির প্রকাশ আর ৭০ দশকের প্রাথমিক রাজনীতির গবেষণা। প্যান্ডেল একটি সাংস্কৃতিক আড্ডার জায়গা ছিল। সেখানে লৌকিক জীবনের ভালোবাসার সুখের সঙ্গে রাষ্ট্রীয় ক্রিয়া প্রতিক্রিয়া প্রতিবাদ মিছিল মিটিং-এর নিয়ে বিতর্কের অবিমিশ্র সুখ পাওয়া যেত। তার সঙ্গে মিশে থাকতো পুজোর গানের রেকর্ড, কাজী সব্যসাচী উৎপল দত্তের আবৃত্তি।এখন টিভিতে টিআরপি বাড়ানোর জন্য কিছু টকশো হয় সেটাকে আমাদের সময়ের বৈঠকী আড্ডা বলা যায় না। সেই সার্বজনীন গেরস্থালি আড্ডার মেজাজ নেই ।

মণ্ডপ যদি মণ্ড পানের স্থান হয় সেই পানের পর্বও আমরা সারতুম। তবে মণ্ডপে নয় দাদা কাম বন্ধু এক দাদার বাড়িতে। সময়ের চেয়ে অনেক এগিয়ে থাকা মানুষ সেই দাদার দাদা ছিলেন আমাদের গুরু। সেই পানের পর্ব অনুষ্ঠিত হতো অষ্টমীর দিন রাতে। তবে তখনও এ ব্যাপারে আমার অনেক বন্ধুর ছুঁৎমার্গ ছিল। আমি তো সময়ের কাপালিক চিরকাল। তন্ত্র মন্ত্র সবই জানি। আমার এসব ধরি মাছ, না ছুঁই পানি– কোনদিনই ছিল না।

সেই আড্ডা ভেঙে গেছে। ডাকের সাজের সেই মাতৃমহিমা আর নেই, নেই অমন টানা টানা মায়ের চোখ বরাভয় দৃষ্টি। বন্ধুরা সব একে একে জীবন তবলার লহরা থামিয়ে ভাগীরথীর পারে ধরে অগ্নি বলয়ের ভেতর চলে গেছে।

আজ সকালে উঠেই যুদ্ধবিধ্বস্ত পাঁচটি শিশুর মুখ দেখি। দেখি আহত মুখে রক্তের দাগ। আর্তনাদী শিশুদের কোলে আগলে রেখে ভয়ার্ত মায়েরা মাথা নিচু করে দৌড়ে পালাচ্ছে। এতো নারী, এতো শিশু পৃথিবী ছাড়া পালাবে কোথায়?

বুঝিনা শেষবেলায় না অবেলায় পৌঁছে গেছি। মনে মনে বিসর্জন শেষে আমি মায়ের বেদিতে একটি নিষ্প্রভ প্রদীপ জ্বালিয়ে বসে আছি।

মণ্ডপকে জগমোহন বলা হয় কেন? স্থাপত্যে এই জগতে মোহময়ী হয়ে ওঠে যে স্থান তাকেই বলে জগমোহন। পৃথিবী কবে জগমোহন হবে, হায়!