আজ যাত্রাপালার সেই যাত্রিক মানুষটি চলে গিয়েছিলেন
যাত্রা দেখে ফাতরা লোকে– এ কথা ভুল প্রমাণ করেছিলেন যে মানুষটি/তমাল সাহা
হেমন্তের পাতা ঝরে গেলে জবুথবু শীত এসে পড়ে এই নাগরিক শহরে। যাত্রার কনসার্ট বেজে ওঠে মাঠে প্রান্তরে। যাত্রা উৎসব হবে পাঁচ দিন ধরে— কতসব নাট্য কোম্পানি! হ্যান্ডবিল ছড়িয়ে পড়ে, রিকশায় প্রচার চলে।
ছোটবেলা থেকে দেখে আসছি যাত্রা হরিসভার আঙ্গিনায়। নৌকা বিলাস, ব্রজলীলা, শ্রীকৃষ্ণকীর্তন, গোপিনীদের বস্ত্রহরণ সেসব কত পালা! দেখেছি নিমাই সন্ন্যাস, রাবণ বধ, সীতার বনবাস, অহল্যা উদ্ধার, দ্রৌপদীর বস্ত্রহরণ আরো কত!
আমাদের কাঁচরাপাড়ায় তখন পাড়ায় পাড়ায় রামযাত্রা হতো। রামচন্দ্রের মালা নিলাম হতো, নিলাম হতো লক্ষ্মণ, হনুমানের মালা, সীতার মালা। রামের মালা খুব মোটা ছিল। সীতার মালা ছিল তুলনায় ছোট। ডাক উঠতো নিলামে। সে যাই হোক মালায়ও ছিল পুরুষতান্ত্রিকতার প্রভাব। না হলে রামের মালা মোটা, সীতার মালা সরু কেন?
এই মালা নিলামে প্রাপ্ত টাকায় নট-নটীরা তাদের পেটের ভাত জোগাড় করতো।
ছোটবেলায় হরিসভায় যে যাত্রা দেখেছি তখন সিক্স সেভেনে পড়ি। পাড়ায় পাড়ায় মালার নিলাম দেখেছি সে বোধ করি আরো বড় হয়ে, এটুকুই এখন মনে পড়ে।
তারপর এল অন্যযাত্রা, বিষয় আঙ্গিকে অন্যরকম। যেমন মুসাফির, সোনাই দিঘি, নটী বিনোদিনী। আর মনে পড়ে শেষ সময়েরও আগে কাঁচরাপাড়ার শিবশংকর অপেরার মহিষাসুরমর্দিনী। ততদিনে তিনি মহিষাসুর হিসেবে পরিচিতি পেয়ে গিয়েছেন। তিনি দীর্ঘদেহী সেই মানুষটি বলহরি নন্দী।
শীতকালীন ঋতুতে যাত্রার আখড়া হয়ে উঠল কাঁচরাপাড়া কলেজ ময়দান, ব্রতচারী পার্ক, এমন কি কবরস্থান ময়দান। চারদিক করোগেটেড টিন দিয়ে ঘেরা এরিনার মাথায় চটের ছাউনি– বিশাল যাত্রা শিবির। পুশ সেল তো ছিলই, লাইন দিয়ে কাউন্টার থেকে টিকিট কেনা। সে এক আশ্চর্য মরশুম!
ঠিক এই সময়ে সাম্রাজ্যবাদী আগ্রাসনে ভিয়েতনামের নাম উত্তাল হয়ে উঠল। প্রেক্ষাপট ক্রমে ক্রমে হয়ে উঠছে রাজনৈতিক। রাষ্ট্রীয় শোষণ, খাদ্য আন্দোলনের কাল। বামপন্থীদের বিশাল সংগঠন– মিছিল মিটিংয়ের উদ্ধত আয়োজন।
তিনি ততক্ষণে যাত্রায় অন্যধারার চরিত্র এনে ফেলেছেন। যাত্রায় একক চরিত্রে তিনি হয়ে উঠছেন পরাক্রমী। অভিনয়ে বাক বৈদগ্ধে সংলাপ ছুড়ে দিচ্ছেন জনতার দিকে।
যাত্রানট শিক্ষক হয়ে উঠতে পারে তার নিশ্চিত প্রমাণ রেখে গেছেন তিনি এই বাংলার যাত্রা জগতে। বই না পড়েও তথাকথিত শিক্ষার জালে আবদ্ধ না থেকেও মূল চেতনার অভ্যন্তরে পৌঁছানো যায়, তা তিনি প্রদর্শন করে গেছেন প্রকৃত জনমাধ্যম এই যাত্রালোকে। তখন তিনি যাত্রা সম্রাট।
একজন নট ‘দলবদলু’ না হয়েও কিভাবে হয়ে ওঠেন বহুরূপী– কখনও লেনিন, কখনো কার্ল মার্কস, কখনো মাও সে তুং, বা সালভাদের আলেন্দে আবার তিনি রূপ বদলে হয়ে যান নেতাজী সুভাষ বা বিবেকানন্দ– ভাবা যায়!
যাত্রাপালায় রাজনৈতিক চেতনা বাম আদর্শের বিস্তারের প্রায়োগিক নৈপুণ্য দেখিয়েছেন তিনি, দেশপ্রেমের চেতনা জাতীয়তাবাদে উদ্বুদ্ধ করেছেন তিনি।
তিনি একজন শিল্পী যে শিল্পীর কাছ থেকে শেখা যায় অনেক কিছু।
অনেকেই যাত্রা দেখেছেন, তার অভিনয়, তার যাত্রাপালা যারা দেখেননি যাত্রা কিভাবে আধুনিক মননশীল চিন্তা চেতনার উপাদান হতে পারে তারা তা ভাবতেই পারবেন না।
তার যাত্রা সংস্থা তরুণ অপেরা ১৯৬৪ সালে গঠিত হয়েছিল। তিনি কাঁচরাপাড়া হাই স্কুলের সুবর্ণজয়ন্তীতে ‘আমি সুভাষ’ হয়ে এসেছিলেন। ১৯৭৫ সালেও ব্রতচারী মাঠে এসেছিলেন নেতাজি হয়ে আর নৈহাটি রেলওয়ে ময়দানে তিনি পর্যায়ক্রমে লেনিন, নেতাজি, কার্ল মার্কস হয়ে গিয়েছিলেন।
যাত্রা দেখে ফাতরা লোকে–এই প্রবাদকে তিনি ভুল প্রমাণ করেছিলেন। শুধু নাটকে কেন, যাত্রাতেও লোক শিক্ষে হয় রে পাগল!
শান্তিগোপাল পাল বাংলা যাত্রাপালায় এক অবিস্মরণীয় চরিত্রের নাম।