প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদার। বিপ্লবী নারী। আজ তার বলিদান দিবস। ভারতবর্ষের স্বাধীনতা সংগ্রামে প্রথম নারী শহীদ

যে মেয়েটি পটাশিয়াম সায়ানাইড খেয়েছিল
তমাল সাহা

কার্ল মার্ক্সের জন্মদিন ৫ মে, ১৮১৮। তিনি তো বিশ্বজনীন।এই ছোট্ট মেয়েটিও ছিল না কম আলোড়নবিহীন। তারও ৫ মে জন্মদিন।
এইটুকু তো তার জীবন, মাত্র একুশ কিন্তু মৃত্যু তার কাছে মেনেছিল হার। এই বয়সেই নিয়েছিল ছদ্মনাম ফুলতার।মেয়েটি ছিল মুক্তিযোদ্ধা, কন্ঠে ছিল বিপ্লবী সুর।

আরে! মেয়েটি তো প্রীতি! প্রীতিলতা! সে তো বিদ্যুত-লতা!ওর ডাক নাম ছিল রাণী। মেয়েটি তো মেয়ে নয়, অন্য ধাঁচের প্রাণী।
মাস্টারদা সূর্য সেনের হাতে গড়া,সশস্ত্র বিপ্লবের দিকে অভিমুখ তার।
পরাধীনতার বিরুদ্ধে ছিল তার প্রতিনিয়ত কড়া নাড়া।

কলকাতার বেথুন কলেজে পড়াশোনা করেছিল প্রীতি। লাঠি খেলা শিখেছিল, শিখেছিল ছোরা চালনা। হিম্মতদার প্রীতি ফাঁসির দণ্ডাদেশপ্রাপ্ত বিপ্লবী রামকৃষ্ণ বিশ্বাসের সঙ্গে আলিপুর জেলে চল্লিশ বার দেখা করেছিল। আলিপুর জেল কর্তৃপক্ষের কাছে সে চিঠি লিখেছিল। পরিচয় দিয়েছিল, আমি অমিতা দাস রামকৃষ্ণ বিশ্বাসের ‘কাজিন’। রামকৃষ্ণ বিশ্বাসের যাপিত জীবন, চারিত্রিক দৃঢ়তা, আত্মহত্যাগের প্রত্যয়ী চেতনা প্রীতিকে মুগ্ধ করেছিল। প্রীতির দাদা বিপ্লবী পূর্ণেন্দু দস্তিদারের সান্নিধ্যে সে তো এসেছিলই আর মহান বিপ্লবী মাস্টারদা সূর্যসেন, বিপ্লবী মনোরঞ্জন রায়-ক্যাবলাদা, তারকেশ্বর দস্তিদার, শৈলেশ্বর চক্রবর্তী, নির্মল সেনের মতো অস্ত্রীদের সংস্পর্শে এসে নিজের জীবনকে অগ্নিশুদ্ধ করেছিল প্রীতি।

প্রীতি একদিন কেঁদে ফেলেছিল। কোন দিন? সে কেঁদেছিল কল্পনার হাত ধরে। সংগঠনের আর্থিক দুরবস্থা জানতে পেরেছিল প্রীতি। পারিবারিক খরচের টাকা বাবা তুলে দিতেন প্রীতির হাতে। প্রীতি বললো, সংগঠনের প্রয়োজনে এই টাকা তুলে দিতে চাই। কল্পনা ওই টাকা নিতে অস্বীকার করলেন। প্রীতি কেঁদে ফেলে! বলে, দেশের প্রতি ভালোবাসার এইটুকু সুযোগ দিলে না তুমি!
প্রীতি একবার অন্য ধরনের পরীক্ষায় বসতে হয়েছিল। পরীক্ষক ছিলেন বিপ্লবী নির্মল সেন। পরিবারের প্রতি টান ও দেশপ্রেমের প্রতি টান সম্পর্কে নির্মল সেন জানতে চাইলে প্রীতি বলে, পরিবারের প্রতি টান থাকা তো স্বাভাবিক কিন্তু ডিউটি টু ফ্যামিলিকে ডিউটি টু কান্ট্রিতে রূপান্তরিত করতে শুধু নয় নিজেকে উৎসর্গ করতে পারি।

প্রীতির জীবনে সবচেয়ে বড় দুঃখ ও আফসোস ছিল, সে সূর্যসেন মাস্টারমশাইয়ের নেতৃত্বে চট্টগ্রাম অস্ত্রাগাল লুণ্ঠনে রাইফেল ধরতে পারেনি, সেই পাহাড়তলীর যুদ্ধে অংশগ্রহণ করতে পারেনি।

তবে এই পাহাড়তলীর অন্য ঘটনায় সে সক্রিয় অংশগ্রহণ করেছিল। চট্টগ্রাম পার্বত্য অঞ্চল। পাহাড়তলিতে ছিল ইউরোপিয়ান ক্লাব– ব্যাপক ফুর্তির আয়োজন।
তার সদর দরজায় লেখা ছিল ‘কুকুর ও ভারতীয়দের প্রবেশ বারণ’।
একুশ বছরের দাপুটে মেয়ে। বুকের ভেতর ভালোবাসার আগুন আর আগুনের ভালোবাসা একাকার। প্রীতি বলে, এত স্পর্ধা, সাম্রাজ্যবাদীরা দেশ-জাতিকে করবে অপমান! জেনে রাখো মেয়েদের বুক আকাশ সাগরের চেয়েও বিশাল< পাহাড়ের চেয়েও উঁচু। সে মাথা হবে কেন অবনত– নিচু?

প্রীতির নেতৃত্বে মাত্র পনেরোজন সেই ক্লাব করেছিল আক্রমণ। লোকে বলে, প্রীতিকে নাকি
গ্রেপ্তার করেছিল পুলিশ।
আসলে সে পড়েনি কো ধরা।মৃত্যুকে যে হাতের তেলোর মতো চেনে,জীবন তাকে দেয় নিয়মিত প্রহরা।

ওষুধের বড়ির মতো সে মুখে পুরে দেয় পটাসিয়াম সায়ানাইড। অগ্নিকন্যা সেই মেয়ে, এক বিপ্লবী ডিনামাইট।প্রীতিলতাই ভারতের মুক্তিযুদ্ধে প্রথম শহিদ নারী।এইসব নারীর কথা আমরা কি কখনো ভুলে যেতে পারি?

শেষ চিঠিতে প্রীতিলতা মাকে কী লিখেছিল, শোনো! তুমি শুধু শুধু কেন কাঁদো মা! দেশমাতাও মা।
তার জন্য উৎসর্গ করো আমাকে।আমায় কোরো ক্ষমা।