হিন্দিতে (पुकार )”পুকার” শব্দের অর্থ আর্তি। এ আর্তিই যেন রাষ্ট্রের প্রতি হাজার হাজার পরিযায়ী শ্রমিকের নিদারুন পরিণতির শেষ নিবেদন। যার সবটাই জুড়ে রয়েছে কষ্ট আর দুর্দশা,আর একটুকরো বাস্তব যা,শুধুমাত্র চোখের জলে ভরা। সবাই জানি রাষ্ট্রই আমাদের রক্ষাকর্তা। তার আদেশের কাছে নতজানু সব্বাই। তবুও কারোর কান্না শুনে কখনো কেন বিগোলিত হয় না রাষ্ট্রের হৃদয়? যদি হতো তাহলে রামপুকার পন্ডিতের কান্না কেনই বা পৌঁছায় না রাষ্ট্রের কানে?
রামপুকার পন্ডিত,যার আর্তি শুনেছে আজ গোটা দেশ। সোশ্যাল মিডিয়ায় ভাইরাল হওয়া কয়েকটা ছবি দেখিয়ে দিলো মানব ইতিহাসের এক হৃদয়বিদারক দৃশ্য। রামপুকার পন্ডিতের সেই বুকফাটা কান্না ছিল পরিযায়ী শ্রমিকদের জীবনের করুন অধ্যায়ের আরেক সংযোজন। এ আর্তি বারে বারে বলে দেয় হাজার হাজার পরিযায়ী শ্রমিকের দুর্দশার কথা। হায়রে !মোর হতোভাগ্য দেশ, যেখানে পেটের খাবার জোগাড় করতে পারি দিতে হয় ভিনরাজ্যে সেখানে তাদের এহেন করুন পরিণতি দেখেও কারো বিন্দুমাত্র সংকোচ হয় না। রামপুকার পন্ডিত বলেন “আমাদের মতো মজুরের কোনো দেশ নেই,আমাদের কোনো জীবন নেই। আমরা চাকার মতো ঘুরেই চলেছি। ” রুজি রুটি পেটের টানে, ছোট বেলায় কাকার হাতধরে দিল্লি পারি দেয় রামপুকার। কখনো দিল্লি কখনোবা গাজিয়াবাদে মজদুরি করতেন। এতদিন দিল্লিতে একটা সিনেমাহল নির্মাণের কাজ করছিলেন বিহারের বেগুসরাই থেকে রাজধানীতে পারি দেওয়া রামপুকার পন্ডিত। লোকডাউনের ফলে হাতে কাজ নেই, বাকি পরিযায়ী শ্রমিকের মতো তিনিও ঠিক করেছিলেন হাঁটা পথে বাড়ি ফিরবেন। মাঝপথে খবর পান তার একমাত্র ছেলে অসুস্থ,খবর পেয়ে ফোনে হাউহাউ করে কাঁদতে থাকেন রামপুকার। একনাগাড়ে বাহাত্তর ঘন্টা কখনো উদ্ভান্তের মতো হেঁটেছেন কখনোবা দৌড়েছেন মাইলের পর মাইল,কখনো ট্রাক বা কখনো পুলিশের কাছে ছুটেছেন সাহায্যের জন্য, তার আকুতি ছিল একবার যেমন করেই হোক অসুস্থ ছেলের কাছে পৌঁছানো। টানাতিনদিন তার কাতর মিনতি পৌঁছায়নি কারো কাছে, তার আবেদনে সাড়া দেওয়া তো দুরের কথা, কখনো কোনো গাড়ি হর্ন দিয়ে পাশ কাটিয়ে চলে গেছে আবার কোনো গাড়ির ধাক্কায় তিনি ছিটকে পড়েছেন। সীমান্ত পেরোতে গেলে পুলিশ চেয়েছে লিখিত কাগজ,শুধু তাই নয়, মাঝ পথে পুলিশের উপদেশ ছিল “তুমি গেলে কি ছেলে ভালো হয়ে যাবে? ” তবুও হার মানেননি পন্ডিত এ যেন ছেলের কাছে ছুটে যাওয়ার শেষ লড়াইটাই বাকি ছিল। যুদ্ধ শেষে যখন গ্রামে ফিরলেন রামপুকার, ততক্ষনে ছেলের শরীরটা দাহ হয়ে গেছে। পুত্র হারা শোকে রামপুকারের কান্নার ছবিটা বলে দেয় শত শত প্রতিশ্রুতির আড়ালে মানব ইতিহাসের সত্যিকারের এক মর্মস্পর্শী পর্বের কথা। যেখানে বিশাল বিশাল বিমানে ফিরিয়ে আনা হয় বিদেশে আটকে পরা ভারতীয়দের,অথচ পুত্রবিয়োগে রামপুকার ছাড়পত্র পায় না ঘরে ফেরার। ভাবতে অবাক লাগে, রামপুকার পন্ডিত যার মতো হাজারো পরিযায়ী শ্রমিকদের ভোটেও নির্ভর করে একটা দেশের সরকারের ভবিষ্যত, রাষ্ট্রের ভবিষ্যত। যে রাষ্ট্র দায়বদ্ধ থাকে তার জনগণের প্রতি, কিন্তু লোকডাউন কালে রামপুকারের চোখের জলে সেই দায়বদ্ধতা একেবারেই বেমানান হয়ে যায়। তাই হাজার সেলফির ফাঁকে,থালি,তালির আওয়াজেও ভেসে আসে রামপুকার দের মতো শত শত পরিযায়ীর কান্নার শব্দ।
সুমনা আদক —–