গৌরকিশোর ঘোষের মুণ্ডু চাই
তমাল সাহা
পড়াশুনো বরাবরই কম। বোধবুদ্ধিও তেমন জুতসই ছিল না। আমার কথা বলছি।প্রাক সত্তর দশকেই যেটুকু শিখেছি সবই ক্রিয়াশীল বন্ধুদের কাছ থেকে। বরাবরই আমার বন্ধু ভাগ্য ভালো। তারা ছিল ব্রিলিয়ান্ট। তারা আমার চিন্তাভাবনার দরজা খুলে দিয়েছে।
বাজার পত্রিকা তো তখন এক নম্বরে। বাজার পত্রিকা আমরা নিয়মিত পড়তুম। কিন্তু বলতুম,বাজারি পত্রিকা আর গালিগালাজ করতুম। পরিবেশ দপ্তর যখন বাম জমানায় সৃষ্টি হয়,এই পত্রিকা ব্যঙ্গ করে বলেছিল এটা আবার কোন দপ্তর!
জরুরি অবস্থা। রাত বিরেতে চুনি বাজারে পুলিশ একদিন ঘিরে ফেললো তার বাড়ি। সে কী পুলিশের মস্তানি! তারপর? তাকে তুলে নিল পুলিশের কালো গাড়ি, মুখে নাকি তখনো আগুন। মানে চুরুট জ্বলছিল। থাক সেসব কথা, কিছু পরে বলি।
এই বাজারি পত্রিকায় সে কাজ করতো। তখনই তার খুব নামডাক। সত্যযুগে এবং তারও আগে আরো দুটি সংবাদপত্রে কাজ করেছিল। এই যে আজকাল। এর স্রষ্টা ছিল সে। বাজারে তখন জোর প্রচার। বাজারকে পাল্টা দেবার একটা কাগজ আসছে। সে বাজার ছেড়ে নতুন পত্রিকা করছে আজকাল।
বাজারি পত্রিকা, দেশ সে কত কলম রূপদর্শীর সংবাদভাষ্য, গৌড়ানন্দ কবিভনে আরো অনেক নামে লিখেছিল। ব্রজদা এমনও একটা নাম ছিল তার।
ধুতি হাফ হাতা পাঞ্জাবি নয় তো বা ফতুয়া টাইপের জামা– এই ছিল তার পরিধেয় পোশাক। চোখে কালো চশমা ভারি ফ্রেম।
আমাকে বলতে দাও– কি বলতে দেবো তাকে? হোটেলের বেয়ারা, জাহাজের খালাসি, ইলেকট্রিক মিস্ত্রি, নাচুনে দলের ম্যানেজার, মাস্টারি, কেরানির জীবন একের পর এক পেরিয়ে সে লিখল দুইল্যা শেখের পাওনাগণ্ডা সরকারি অনুদানের হিসেব নিকেশ মানে হঠকারী জীবনের রিপোর্ট– শেষমেশ হয়ে গেল সাংবাদিক-সাহিত্যিক, নিবন্ধ-প্রবন্ধকার।
পশ্চিমবঙ্গ এক প্রমোদ তরণী হা হা! তলিয়ে যাবার আগে। কাদের তলিয়ে যাবার কথা বলেছিল সে? প্রেম নেই, কোথায় প্রেম ছিল না,সে কি দেখেছিল কে জানে? ব্যক্তিগত অশ্রদ্ধা কিভাবে গোষ্ঠীদ্বন্দ্বে পৌঁছে যায়। তারপর সাম্প্রদায়িকতার রূপ পেয়ে যায় তা সে বুঝেছিল।
বাবরি মসজিদ ধ্বংসের পর তার প্রতিক্রিয়া হয়েছিল খুব।
সে যে অসাম্প্রদায়িক ছিল তা প্রজন্মদের নামকরণের মধ্য দিয়ে সূচিত করে গেছে।
লেখাপড়া না জানা শ্রমিক তো বহধা চরিত্রের মিশেল হবে এটাই তো বাস্তব। সাগিনা মাহাতোকে সে এভাবেই গড়ে তুলতে চেয়েছিল এক স্বাভাবিকতায়। মজদুর নেতা আচরণে মিশে যাওয়া মানুষ। তার নেশা থাকবে, প্রেম-যৌনতা থাকবে, থাকবে লড়াইয়ের উদ্দীপনা। এমনই সাগিনা মাহাতো সে চেয়েছিল। তার ব্রজবুলি, বাঘবন্দীতে উত্তমকুমার অভিনয় করেছিলেন।
আলোড়ন ফেলে দিলো ১৯৭৫ সালে। মস্তক মুণ্ডিত শ্মশ্রুবিহীন মুখ। সবাই দেখে আশ্চর্য হয়ে গেল। তার তো কোন আত্মীয় বিয়োগ হয়নি! সে বলল, মাতৃ বিয়োগ হয়েছে।
জরুরি অবস্থা– কণ্ঠরোধ। স্তব্ধ কলম। সংবাদ সেন্সর্ড। দেশমাতা কথা কইবে না? আমি মাতৃহীন। কলকাতা- পত্রিকায় লিখলো জরুরি অবস্থার বিরুদ্ধে।
বাজারে চালু ছিল সে কমিউনিস্ট বিরোধী। র্্যাডিক্যাল হিউম্যানিস্ট। বন্ধুরা বলে, এ তো কথার জাগলারি, ধাপ্পাবাজি! কমিউনিস্ট ছাড়া হিউম্যানিস্ট হওয়া যায় নাকি?আমি বলি, হিউম্যানিস্টস, তা আবার রেডিক্যাল কেন? বন্ধুরা বলে, এবার নিজে নিজে একটু বুঝতে শেখো, নে ছাড় তো!
শুনেছি বিয়ে হয়েছিল। বিয়েতে উপহার নেয়নি? খাওয়ায়ও নি। দুটাকা, না পাঁচ টাকা দিয়ে বিয়ের রেজিস্ট্রি অনুষ্ঠানে ঢুকতে হয়েছিল। নিজের কাকা এমনকি বাবাকেও কুপন কাটতে হয়েছিল।
তো জরুরি অবস্থায় গ্রেপ্তার হয়ে গেল। বন্ধুদের বলি, সিদ্ধার্থশঙ্কর রায়ের অতি পরিচিত, বাজারি পত্রিকার নামজাদা সাংবাদিক মিসায় গ্রেপ্তার! জেল খাটবে? বন্ধুরা,বলে এও এক কৌশলী প্রক্রিয়া। নাম ফাটবে। বরানগর এলাকা চুনি বাবুর বাজারের কাছে সে থাকতো। পরে বোধ করি বিধান নগরে চলে গিয়েছিল। নকশাল আন্দোলনের কঠোর বিরোধিতা করেছিল। অথচ নকশালদের হত্যার বিরুদ্ধে সোচ্চারে কলম ধরেছিল হত্যাকাণ্ডের বিবরণ তুলে ধরেছিল সংবাদপত্রের পাতায়। রূপদর্শীর সংবাদভাষ্য কলমে।
তখন বাজারে তিনটি শব্দ খুব চালু ছিল। শব্দ তিনটি বিশদ বুঝি আর না বুঝি আমিও বলতুম। বুর্জোয়া, সিআইয়ের এজেন্ট, আমেরিকার দালাল। তার নামে পোস্টারও পড়েছিল—
গৌরকিশোর ঘোষের মুণ্ডু চাই। সে ম্যাগসেসে পেয়েছিল। ম্যানিলায় গিয়েছিল।শুনেছি বিদেশি উপস্থাপক তো!উচ্চারণের দোষে দুষ্ট হয়ে তার নাম বলেছিল, গরু কিশোর ঘোষ!