অবতক খবর,২১ মার্চ,মালদা: মালদহের হরিশ্চন্দ্রপুর বন্যার ত্রাণ কেলেঙ্কারিতে আবার চাঞ্চল্যকর মোড়। সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশ বলে দু সপ্তাহ শেষ হওয়ার আগেই থানায় আত্মসমর্পণ করলেন বন্যার ত্রাণ কেলেঙ্কারির আরেক অভিযুক্ত তৃণমূল নেত্রী তথা হরিশ্চন্দ্রপুর ১ নম্বর পঞ্চায়েত সমিতির নারী-শিশু ত্রাণ কর্মাদক্ষ রোশনারা খাতুন। সোমবার সকালে তিনি থানায় আত্মসমর্পণ করেন। আজ তিনি চাঁচল মহকুমা আদালতে আত্মসমর্পণ করবেন। এদিন তিনি জানান তিনি এই কেলেঙ্কারিতে জড়িত নন। তাকে ফাঁসানো হয়েছে। মাস্টার রোলের তার সই জাল করা হয়েছে। রোশনারা খাতুন এর বক্তব্য তাকে ফাঁসানো হয়েছে।তার সই জাল করা হয়েছে। পিছনে বড় মাথা আছে। এর আগে তিনি ২০১৯ এবং ২০২১ সালে এ বিষয়ে তিনি অভিযোগ দায়ের করেছিলেন। মহামান্য সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশে তিনি থানায় আত্মসমর্পণ করলেন। পুলিশ তদন্ত করলে সব বেরিয়ে আসবে।

উল্লেখ্য এ গত সপ্তাহ এর শেষে হরিশ্চন্দ্রপুর বন্যার ত্রাণ কেলেঙ্কারির আরেক অভিযুক্ত বড়ই অঞ্চলের তৃণমূল নেতা আফসার হোসেন আত্মসমর্পণ করেন। তিনিও জেরার মুখে জানিয়েছিলেন দলের বড় বড় রাঘব-বোয়াল এর পিছনে রয়েছে। তিনি নির্দোষ তাকে ফাঁসানো হয়েছে। গত সপ্তাহে তিনি আদালতে আত্মসমর্পণ করেন। বর্তমানে তাকে দশ দিনের পুলিশি রিমান্ডে নেওয়া হয়েছে।

প্রসঙ্গত হরিশ্চন্দ্রপুর ১ নম্বর ব্লকে ২০১৭ সালের বন্যার ক্ষতি-গ্রস্তদের জন্য দুই দফায় ১৩ কোটি টাকা স্যাংশন হয়েছিল। কিন্তু অভিযোগ এই টাকা প্রকৃত বেনেফিশিয়ারি না পেয়ে বেশ কিছু তৃণমূল নেতা এবং জন-প্রতিনিধিদের পকেটে গিয়েছে। এর মধ্যে পঞ্চায়েত সমিতি স্তরে ৩ কোটি ৫০ লক্ষ টাকার মতো দুর্নীতির অভিযোগ হয়েছে। এই নিয়ে কলকাতা হাইকোর্ট এবং সুপ্রিম কোর্টে মামলা দায়ের হয়েছে।

উল্লেখ্য বিগত সপ্তাহে সুপ্রিম কোর্টে নির্দেশ দেয় অবিলম্বে হরিশ্চন্দ্রপুর বন্যার ত্রাণ কেলেঙ্কারিতে প্রধান অভিযুক্ত বরই গ্রাম পঞ্চায়েতের প্রধান সোনা মনি সাহা, হরিশচন্দ্রপুর পঞ্চায়েত সমিতির কর্মাদক্ষ রোশনারা খাতুন, এবং বরই অঞ্চলের প্রভাবশালী তৃণমূল নেতার তথা প্রাথমিক শিক্ষক আফসার হোসেনকে অবিলম্বে সুপ্রিমকোর্টে আত্মসমর্পণ করতে হবে। কিন্তু এ তিন জন দীর্ঘদিন ধরেই পলাতক। আফসার হোসেন আত্মসমর্পণ করার কিছু দিনের মধ্যেই আরেক অভিযুক্ত পঞ্চায়েত সমিতির কর্মদক্ষ নারী-শিশুর ত্রাণ রোশনারা খাতুন আত্মসমর্পণ করা হরিশ্চন্দ্রপুরে ঘটনার নতুন মোড় নেবে বলে মনে করছেন এলাকার রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞরা।

প্রসঙ্গত হরিশচন্দ্রপুর বরই গ্রাম পঞ্চায়েতের বন্যার ত্রাণ কেলেঙ্কারিতে এর আগে অভিযুক্ত তালিকায় ছিলেন হরিশচন্দ্রপুর পঞ্চায়েত সমিতির সভাপতি কোয়েল দাস, পঞ্চায়েত সমিতির সদস্যা তথা বিরোধী দল-নেত্রী সুজাতা সাহা, হরিশ্চন্দ্রপুর পঞ্চায়েত সমিতির কর্মাদক্ষ দক্ষ রোশনারা খাতুন, বরই গ্রাম পঞ্চায়েতের প্রধান সোনা মনি সাহা এবং বড়ই অঞ্চলের প্রভাবশালী তৃণমূল নেতা প্রাথমিক শিক্ষক আফসার হোসেন। এদের বিরুদ্ধে হাইকোর্টে মামলা করেন বরই গ্রাম পঞ্চায়েতের বিরোধী দলনেতা আব্দুল মান্নান। হাইকোর্টের নির্দেশে হরিশ্চন্দ্রপুর ১ নম্বর ব্লকের বিডিও অনির্বাণ বসু এদের নামে থানায় অভিযোগ দায়ের করেন।

যদিও হরিশ্চন্দ্রপুর পঞ্চায়েত সমিতির সভাপতি কোয়েল দাস এবং সুজাতা সাহা হাইকোর্ট থেকে বেল পেয়ে যান। সুজাতা সাহার বন্যার ত্রাণ কেলেঙ্কারিতে মাস্টাররোলে তার সই জাল করা হয়েছিল। এমনকি অভিযোগও জানিয়ে ছিলেন তিনি। কিন্তু বাকি তিন অভিযুক্ত পলাতক হয়ে ছিলেন। কোন হদিস পাচ্ছিল না পুলিশ। এলাকার বিরোধীরাও পুলিশ প্রশাসনের নিরপেক্ষতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছিলেন।

বিরোধীদের অভিযোগ ২০১৭ সালের বন্যায় সম্পূর্ণভাবে ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারগুলোকে ৭০ হাজার ও আংশিক ভাবে ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারগুলোকে ৩,৩০০ টাকা ক্ষতিপূরণ দেওয়ার ঘোষণা করেছিলেন রাজ্য সরকার। জেলায় মোট ৫২ কোটি টাকা বরাদ্দ হয়েছিল।

কিন্তু ভুয়া অ্যাকাউন্ট তৈরি করে বেশির ভাগ টাকা আত্মসাৎ করার অভিযোগ উঠেছিল ক্ষমতাশালী এই তৃণমূল নেতা এবং বরই গ্রাম পঞ্চায়েতের প্রধান সহ একাধিক জন-প্রতিনিধির বিরুদ্ধে। ৭৬ লক্ষ টাকা গরমিল ধরা পড়ে গ্রাম পঞ্চায়েতে। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক তৃণমূলের একাংশের দাবি এই কেলেঙ্কারির পিছনে বড় বড় রাঘব-বোয়াল নেতা জড়িয়ে আছে। ভিন রাজ্যে বিভিন্ন বাসিন্দাদের একাউন্টে এই টাকা পাঠানো হয়েছে। আসল বেনেফিশিয়ারি টাকা পাননি।জেলার হরিশ্চন্দ্রপুরের বরুই গ্রাম পঞ্চায়েতে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিলেন ৭ হাজার ৩৯৪ জন।তদন্তের যা গতিপ্রকৃতি তাতে ঠিক মত চলে এতে অনেকের নাম উঠে আসবে।

আত্মসমর্পণকারী তৃণমূল নেত্রী তথা পঞ্চায়েত সমিতি নারী ও শিশু ত্রাণ কর্মাদক্ষ রোশনারা খাতুন বলেন, আদালতের নির্দেশে আমি নিজে এসে আজ আত্মসমর্পণ করলাম। কিন্তু আমি নির্দোষ আমাকে ফাঁসানো হয়েছে। এই নিয়ে এর আগে আমি থানায় অভিযোগ করেছিলাম। আমি কিছু জানিনা, যা জানার বিডিও সাহেব জানেন।

উত্তর মালদা সাংগঠনিক জেলা বিজেপির সম্পাদক রুপেশ আগরওয়াল বলেন, এদের প্রত্যেকেই আত্মসমর্পণ করতে হবে। যে ভাবে বন্যা দুর্গত মানুষদের ত্রাণ নিয়ে দুর্নীতি করেছে তা অত্যন্ত নিন্দনীয়। মহামান্য আদালত জামিনের আবেদন খারিজ করেছে তাই আত্মসমর্পণ ছাড়া উপায় নেই। আর শুধু বন্যার ত্রাণ কেলেঙ্কারি নয় প্রত্যেকটা সরকারি প্রকল্পে ব্যাপকহারে দুর্নীতিতে যুক্ত শাসক দল। কিছু দিনের মধ্যে কেন্দ্রীয় তদন্তকারী সংস্থা তদন্তে নামবে তখন সব কিছু পরিষ্কার হয়ে যাবে। শাসকদল পরিচালিত প্রত্যেকটা গ্রাম পঞ্চায়েতের প্রধান ,উপ-প্রধান ফাঁসবে।

মূল অভিযোগকারী বরুই গ্রাম-পঞ্চায়েতের কংগ্রেসের বিরোধী দল-নেতা আব্দুল মান্নান বলেন,দুইজন আত্মসমর্পণ করলো। আরেকজন বাকি আছে। এরা প্রত্যেকে মহা কেলেঙ্কারিতে যুক্ত। বন্যা কবলিত অসহায় মানুষদের জন্য পাঠানো কোটি কোটি টাকা এরা আত্মসাৎ করেছে। তাই সুপ্রিমকোর্টের কাছে জামিনের আবেদন খারিজ হয়েছে। আইনের উপর আমাদের আস্থা রয়েছে। কঠোর শাস্তির দাবী জানাই।

তৃণমূল নেতা তথা হরিশ্চন্দ্রপুর চেয়ারম্যান সঞ্জীব গুপ্তা বলেন, আমাদের পঞ্চায়েত সমিতির কর্মাধক্ষ্যা রোশনারা খাতুন আত্মসমর্পণ করেছেন। উনারা বন্যা দুর্নীতিতে জড়িত ছিলেন। মুখ্যমন্ত্রীর নির্দেশে বিডিও অভিযোগ দায়ের করেছিলেন। সুপ্রিম কোর্ট জামিনের আবেদন খারিজ করেছে। তাই আত্মসমর্পণ ছাড়া উপায় নেই। দল কোন রকম দুর্নীতি মেনে নেবে না। আইন আইনের পথে চলবে।

ভয়াবহ বন্যার ফলে বহু মানুষের ঘরবাড়ি চলে গেছিল জলের তোড়ে। নষ্ট হয়েছিল চাষের জমি। সেইসব অসহায় মানুষদের জন্য সরকারের পাঠানো ত্রাণ নিয়ে যারা দুর্নীতি করেছে তাদের উপযুক্ত শাস্তি হওয়া দরকার।