সেই ভয়াবহতা….

” মানুষ বড়ো কাঁদছে, তুমি মানুষ হয়ে পাশে দাঁড়াও
মানুষই ফাঁদ পাতছে, তুমি পাখির মত পাশে দাঁড়াও
মানুষ বড়ো একলা, তুমি তাহার পাশে এসে দাঁড়াও।

তোমাকে সেই সকাল থেকে তোমার মত মনে পড়ছে
সন্ধে হলে মনে পড়ছে, রাতের বেলা মনে পড়ছে
মানুষ বড়ো একলা, তুমি তাহার পাশে এসে দাঁড়াও।

এসে দাঁড়াও ভেসে দাঁড়াও এবং ভালোবেসে দাঁড়াও
মানুষ বড়ো কাঁদছে, তুমি মানুষ হয়ে পাশে দাঁড়াও
মানুষ বড়ো একলা, তুমি তাহার পাশে এসে দাঁড়াও।”

—–শক্তি চট্টোপাধ্যায়এর

কবিতাটা আজ যেন বাস্তব। দেশের অনেক প্রান্তেই নেভেনি গণচিতার আগুন, দাউ দাউ করে জ্বলছে শ্মশানের কাঠ চুল্লি, গর্ত ভরেনি কবরের। চোখের সামনে পড়ে রয়েছে লাশের পাহাড়। একই হয়তো বলে বিভীষিকা, হ্যাঁ মহামারীর ভয়ঙ্কর এক ছবি। আজ যে গেল কাল সে ছিল, পর্দায় নয় ভয়ঙ্কর বাস্তবের কঠিন সময়ে আমাদের হয়ে লড়াই করা সেই রিয়েল হিরোরা আমাদের ডাক্তার, নার্স কিংবা স্বাস্থ্যসেবার কর্মীরা রাত দিন এক করে জীবনযুদ্ধের সংকটে তারা কর্তব্যরত।আশঙ্কা রয়েছে কে বাঁচবে আর কাকেই বা বাঁচাবে? যারা রয়ে গেল তারাও বোধহয় অশনিসংকেত আর অনিশ্চয়তার ঘেরাটোপে ঘুরে মরছে। প্রতি চব্বিশ ঘন্টায় আক্রান্তের সংখ্যাটা চার লক্ষের কাছাকাছি, আর মৃত্যুর হিসেবটা নাইবা বললাম। বোধহয় মহামারীর এমন এক ভয়ানক পরিস্থিতির বিবরণ ইতিহাসের পাতাতেও অনেক কমই লেখা হয়েছে। তবুও রাজনীতির শেষকৌশল রয়েছে, কিন্তু শেষমেষ দেখা গেলো মোহাম্মদ-জগন্নাথ একে ওপরের জন্য একসাথেই এবারের লড়াইটা লড়ছে। তাইতো মন্দির মসজিদের দোরগোড়ায়তেও কবিডসেন্টারে অসংখ্য রুগীঠাই নিয়েছে। হ্যাঁ এটাই বাস্তব, আর এটাই আমাদের ভারতবর্ষের পরিচিত পুরোনো সেই ছবিটা, যেটা মাঝে মধ্যেই লুকিয়ে পড়তো হিংসার আড়ালে। দেশটা অতিমারীর যন্ত্রনায় ক্ষতবিক্ষত হয়ে ছটফট করছে, তবু হারেনি এখনো বীরযোদ্ধার মতো লড়াই টা সে চালিয়ে যাচ্ছে। ইতিমধ্যে তিব্র অক্সিজেনের সংকট দেশজুড়ে,তারমধ্যেই চব্বিশটি ক্রায়োজেনিক অক্সিজেন ট্রাঙ্ক নিয়ে অসহায়দের পাশে যেন ‘দেবদূতের’ মতো আবির্ভাব হলেন রতন টাটা তার টাটাগোষ্ঠী। সিরাম ইনস্টিটিউটসনের সিইও আদর পুনাওয়ালা জানিয়েছেন তাদের 300 কন্টেনার কবিড ভ্যাকসিন বোঝাই করে দেশের ভিন্ন প্রান্তে রওনা দিয়েছে। পাশাপাশি ভারত বায়োটেকও তাদের ভ্যাকসিন সরবরাহে সদা প্রস্তুত, তড়িঘড়ি তারাও হাত লাগিয়েছে প্রাণ উদ্ধারে।

আন্তর্জাতিক মহলে ভারতবর্ষের উদারতা সর্বকালের বিশ্বপ্রসিদ্ধ, দুঃসময়ে ব্রিটিশ গভর্মেন্ট চারশো পঁচানব্বইটি অক্সিজেন কন্সেন্ট্রেটর আর একশো চল্লিশটির বেশি ভেন্টিলেটর দিয়ে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছে ভারতের দিকে। পাশে দাঁড়িয়েছে দুবাই, সৌদি আরবের মতো দেশগুলো, ইতিমধ্যে যেখান থেকে আশি মেট্রিকটন লিকুইড অক্সিজেন পৌঁছেছে ভারতে। ভারতীয় বায়ুসেনার সাহায্যে সিঙ্গাপুর থেকে অত্যাধুনিক ক্রায়োজেনিক অক্সিজেন ট্যাংক এসেছে। ফ্রান্স আঠারোটি লিকুইড অক্সিজেনকনটেনার্স সহ আঠাশটি রেস্পরিটরস এবং দুশোর বেশি ইলেকট্রিক সিরিঞ্চপাম্প দিয়ে সাহায্য করেছে ভারতকে। জার্মানি তেইশটি অক্সিজেন জেনারেশন প্লান্টস, রাশিয়া মেডিসিন পিপিই কিট্স্ পাঠিয়েছে ভারতে। আমাদের এই কঠিন সময়ে ভুটান থাইল্যান্ড এর মতো ছোট্ট দেশগুলোও আশ্বাস দিয়েছে পাশে থাকার।

আন্তর্জাতিক কিংবা অভ্যন্তরীণ কিছু মুষ্টিমেয় উস্কানিতে উত্তেজিত হয়ে রাজনীতির প্রতিহিংসা ছড়ালেও, আজকাল দিনেরশেষে গণচিতার শিখা দেখে,বা কভিডে মৃত মায়ের পাশে আঠারো মাসের শিশুর কান্না শুনে হয়তো তারাও কখনো কখনো আক্ষেপ করে। দেশের সর্বত্র ছবিটা হয়তো তাদেরও ভাবায়। আর সেটাই স্বাভাবিক বলেই দেশটার নাম ভারতবর্ষ যেখানে একাধারে জাত, ধর্ম, রাজনীতির রং নিয়ে লড়াই হলেও আবার পরক্ষনেই মনে হয়েছে অন্যকথা, সে কথা বর্ণনা দেয় এক অখণ্ড গৌরবের, যার মোহময়তা আকর্ষিত করে বিশ্বকে।

একদিকে মহামারীর আঘাতের যন্ত্রনা তার প্রিয়জন হারানোর বেদনায় ক্ষত হয়ে কেঁদে চলেছে আমাদের দেশটা চিরকালই যার ভুত, ভবিষ্যত বর্তমানের উদারতা আর প্রতিদ্বন্দ্বিতা, চিন্তার ভাঁজ ফেলেছে অন্যের কপালে, এমন অসহায় সময়ে তার পাশে কি আর না থাকলে চলে? দুনিয়ার সব ভারতীয় অর্থ শক্তি দিয়ে জোট বেঁধে লড়াই করছে নিজেদের দেশের রক্ষার্থে। বিভিন্ন সরকারি বেসরকারি আধাসরকারি সেবা প্রতিষ্ঠান সাহায্যার্থে রয়েছে আমাদের সাথে। একবার চেয়ে দেখুন একসময় রাম-রহিম যেমন রক্ত ঝরিয়েছে আবার বিপদের দিনে একে ওপরের জীবনবাঁচাতে তারাই ছুটে এসেছে, একে অন্যের সঙ্গী হয়েছে শেষযাত্রায়। কখনো গণকবর, গণচিতার আগুন নেভানোর জন্য লড়াই করছে একসাথে। প্রতিনিয়ত হৃদয়নিঙড়ানো বেদনার দৃশ্যগুলো করোনার বিধি-বিধান কে আরো বেশি করে মানতে শেখাচ্ছে বারবার। সেটাই তো ঠিক, হঠাৎ করে ঘূর্ণিঝড়ের মতো অশুভ শক্তি ছুটে এসে গিলে ফেলতে চাইছে আমাদের অস্তিত্বকে, তাকে নস্যাৎ করে শেষ চেষ্টায় বাঁচিয়ে রাখতেই হবে শতকোটির অখণ্ড দেশটাকে। এ দেশের ইতিহাসও সাক্ষী ছিল অনেক লড়াইয়ের যা কেউ দেখছি কেউ বা শুনেছি, আমাদের সম্প্রীতির ছবিগুলো তার অনেক প্রমান দিয়েছে। কবির ভাষায় —- আমরা পেরেছি জিততে, তাই এবারটাও পারবো।

সুমনা আদক —-