এই সেই কাঁচরাপাড়ার তরুণ, যে শহিদের মৃত্যুবরণ করেছিল।
নগরবাসী কেউ জানে না। সকালে উঠে দেখি শহরের অশোক শিমুল কৃষ্ণচূড়া গাছগুলি মাথা নত করে আছে। আজ এই জনপদে শহিদ দিবস। আজই সেই দিন যে দিন দীন বসু লেনের অধিবাসী রক্তে তুফান তোলা সেই তরুণটি অশোক মিত্র শহিদ হয়েছিল ধোবিপুকুর রোডে ৫৮ বছর আগে।
ধোবিপুকুর রোডের নাম পরিবর্তন করে অশোক মিত্র রোড করা হয়েছিল। সেই শহিদকে অপমানিত করে রাস্তাটির নাম বদলে আরেক সমাজকর্মীর নামে উৎসর্গ করা হল– মৃণাল সিংহরায় সরণি। জানিনা কারা কাকে অপমান করল! শহিদ অশোক মিত্র অপমানিত হলো, না শহিদের নাম হটিয়ে সমাজকর্মী মৃণাল সিংহরায়কে সম্মানিত করা হলো! কি জানি, কে জানে?
সেদিনও গোধুলি বেলা রক্তাভ উজ্জ্বল ছিল
তমাল সাহা
সেদিনও গোধুলি বেলা রক্তাভ উজ্জ্বল ছিল।
ছেলেটি পড়াশুনায় তেমন ভালো না থাকলেও দুর্জয় দুরন্ত ছিল।
বোধ করি বারবার ব্যর্থ হবার কারণে দু-দুটো স্কুল পাল্টে ছিল।
সেদিনও গোধুলি বেলা রক্তাভ উজ্জ্বল ছিল।
একটা জীবনে দুবার স্কুল পাল্টালেও বন্ধুতার পরিমাণ অনেক বেড়ে গিয়েছিল। ছেলেটিকে ঘিরে অসংখ্য ছেলে জটলা করেছিল।
আমি ছেলেটির দিকে আশ্চর্য হয়ে তাকিয়ে থাকতুম!
সেদিনও গোধুলি বেলা রক্তাভ উজ্জ্বল ছিল।
ছেলেটি সেদিন কবরস্থান ময়দানে মিছিল প্রস্তুতির তদারক করছিল।
পড়াশুনায় হয়তো দুর্বল ছিল কিন্তু সংগঠক হিসেবে সবল ছিল।
আমি ভাবতুম এটা কি করে হয়!
তার আগেই
ছেলেটি ছেষট্টির খাদ্য আন্দোলনে বোমা মারতে গিয়ে ধরা পড়েছিল এবং জেল খেটেছিল
সেদিনও গোধুলি বেলা রক্তাভ উজ্জ্বল ছিল।
শিক্ষক আন্দোলন চলছিল।
ছেলেটি বলল, ধুর তোর পড়াশুনো!
শিক্ষক আন্দোলন একলা হয় নাকি? মাস্টারমশাইরা একা একা পারে নাকি?
ছাত্র-যুবদেরও যোগদান চাই।
সেদিনও গোধূলি বেলা রক্তাভ উজ্জ্বল ছিল।
মাস্টারমশাই মনে পড়ে, তোমাদের বিক্ষোভে তারুণ্যের জোয়ার!
কবরস্থান মাঠের কোণে লাল ফুলে উদ্জ্বল একটি শিমুল গাছ মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে ছিল।
চলমান মিছিলের উপর দিয়ে বসন্ত বাতাসে উড়ে যাচ্ছিল।
সেদিনও গোধুলি বেলা রক্তাভ উজ্জ্বল ছিল।
ঘিরে ফেলা হলো স্কুল পরিচালকের বাড়ি।
সন্ধ্যা নামছে। আকাশে চাঁদ ক্রমশ গোলাকার হতে থাকে। ফুটতে থাকে তারা। স্লোগান ওঠে দুর্বার,রুখে দাও ছাঁটাই!
বরখাস্ত মাস্টারমশাইদের পুনর্বহাল চাই!
নিভে গেল সব স্ট্রিটলাইট। পুলিশের গাড়ি এলো। চলল ব্ল্যাংক ফায়ার। ক্রমাগত বাড়ে স্লোগানের জোয়ার। পুলিশ! তুমি দূর হটো!
সেদিনও গোধুলি বেলা রক্তাভ উজ্জ্বল ছিল।
আন্দোলন তীব্র থেকে তীব্রতর হল।
স্কুল পরিচালকের বাড়ির ছাদ থেকে ছুঁড়ে দেয়া হলো বোতল- ইট-পাথর।
ছেলেটির মাথা গুরুতর জখম। পড়ে রইল রাস্তার অ্যাসফল্টের উপর নিথর।
সেদিনও গোধুলি বেলা রক্তাভ উজ্জ্বল ছিল।
কত শহিদের কথা লিখে যাই গেঁয়ো রোগী পায় না ভিখ– আমরা জানি সবাই।
ছেলেটির পড়াশুনোয় গলতি ছিল! ছেলেটি তো লড়াকু ছিল।
পার্টি গিয়েছ ভুলে তার মৃত্যুদিন।
শহিদবেদিটি কোথায় কেউ জানেনা। সবাই আছে চোখ তুলে!
শহিদ বেদিতে ধুলোর আস্তরণ, ভর্তি হয়েছে মাকড়ের বাসার ঝুলে।
সেদিনও গোধুলি বেলা রক্তাভ
উজ্জ্বল ছিল।
চার এপ্রিল,উনিশশো আটষট্টি– আটান্ন বছর আগে ঘটনাটা গিয়েছিল ঘটে।
এখন আর এখানে অশোক ফুল ফোটে না।
শহিদ! শহিদ! খবরের কাগজে গিয়েছিল রটে।
পৃথিবীর ইতিহাসে যুগান্তকারী ঘটনা শিক্ষক আন্দোলনে প্রথম ছাত্র শহিদ, সে হয়েছিল বটে!
সেদিনও গোধুলি বেলা
রক্তাভ উজ্জ্বল ছিল।
অন্ধকার রাতে তার দেহে জ্যোৎস্নার আলো ঝরে পড়েছিল।