কাঁচরাপাড়ার পাল্কি এবং স্যার আশুতোষ মুখোপাধ্যায়
তমাল সাহা
আজ বাংলার বাঘের জন্মদিন। মানুষটি হাইকোর্টের বিচারপতি ছিলেন। তাঁর চেয়েও বড় তিনি ছিলেন শিক্ষাবিদ। ছিলেন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম ভাইস চ্যান্সেলর। জাতীয়তাবাদী মানুষ ছিলেন তিনি। কলেজ স্ট্রিট ও রাজাবাজার ক্যাম্পাসে কলা ও বিজ্ঞান শাখার প্রণয়ন করেন। ‘দেশী ভাষা’ ও ‘প্রাচীন ইতিহাস’ বিভাগের প্রচলন করেন। তিনি নিজ উদ্যোগে সমস্ত বিভাগের সিলেবাস প্রণয়নেরও তত্ত্বাবধান করতেন। এমনই ছিল তাঁর প্রমা ও প্রজ্ঞা।
কোথায় পাল্কি আর কোথায় স্যার আশুতোষ, কার সঙ্গে কি? আর যত গল্প গাথা যেন কাঁচরাপাড়ার কপালেই লেখা ছিল!
পাল্কির কথা উঠলে ছন্দের জাদুকর সত্যেন্দ্রনাথ দত্তের কথা কার না মনে পড়বে?
পাল্কি চলে গগনতলে/ হুম না, হুম না– এই সুর নস্টালজিক ছায়ায় মন কেমন একটা হারানো বিষাদকে ঘন করবেই।
অথবা রবীন্দ্রনাথের ‘বীরপুরুষ’ কবিতাটি– মাকে নিয়ে পাল্কিতে করে অনেক দূরে যাত্রা। বঙ্কিমচন্দ্রের উপন্যাসে পাল্কিতে বসে থাকা ‘দেবী চৌধুরাণী’ আর চুমড়ানো গোঁফ দশাশই বেহারাদের চেহারা চোখের সামনে ভেসে উঠবেই। অবশ্য অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘রাজকাহিনী’-তে জমকালো তাঞ্জামের কথাও আমাদের ততদিনে জানা হয়ে গিয়েছে। আর এর সঙ্গে জুড়ে গেল কি না রয়্যাল বেঙ্গল টাইগারের নাম?
ঢিল মারলে পাটকেলটি খেতে হয় এটা আমরা ছোটবেলায় স্যার আশুতোষের কাছ থেকেই শিখেছিলাম। ট্রেনে বাঙালির জুতো আর সাহেবের কোট হারানোর ঘটনায়। তিনি ছিলেন শিক্ষাবিদ। তিনি তো মানুষকে উপযুক্ত শিক্ষা দেবেনই।
শেষ পর্যন্ত কাঁচরাপাড়ার পাল্কি আর আশুতোষ মুখুজ্জে মিলেমিশে গেল।
একসময়ে কাঁচরাপাড়া ইস্টিশনে পাল্কির স্ট্যান্ড ছিল। সেসময় রিক্সা বা অটোর চল ছিল না। গ্রাম কাঁচরাপাড়ার শুকিয়ে যাওয়া যমুনা নদীর উত্তর খাতে একটি গাঁ ছিল। তার নাম ছিল গুনতিয়া গ্রাম– পাল্কি বেহারাদের বসতি।
সেসময় কাঁচরাপাড়া মাঝেরপাড়া গ্রামে থাকতেন শ্যামাচরণ দে। কাজকর্ম? তিনি কলকাতার শেয়ার ও কোম্পানির কাগজের দালালের কাজ করতেন। তাঁর নিজেরই দুটো পাল্কি ছিল। তিনি এই পাল্কি করেই মাঝেরপাড়া গ্রাম থেকে কাঁচরাপাড়া ইস্টিশনে যাতায়াত করতেন। তিনি ছিলেন শিক্ষাবিদ, অধ্যাপক এবং কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের পরীক্ষক সতীশচন্দ্র দের পিতা। বিখ্যাত গ্রন্থ “গৌরাঙ্গদেব ও কাঞ্চনপল্লী” র লেখক ছিলেন সতীশচন্দ্র দে। সেখানে গ্রাম কাঁচরাপাড়া তথা কাঞ্চনপল্লীর সম্পূর্ণ ইতিহাসটাই তুলে ধরা আছে।
এই লেখকের প্রতিবেশী ছিলেন আরেক বিখ্যাত শিক্ষাবিদ সতীশচন্দ্র রায়। ইনি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনা করতেন। স্যার আশুতোষ মুখোপাধ্যায়ের বোনের সঙ্গে তিনি পরিণয় সূত্রে আবদ্ধ হয়েছিলেন। স্বাভাবিকভাবেই স্যার আশুতোষ মুখোপাধ্যায় বোনের বাড়ি কাঁচরাপাড়ায় আসতেন। কাঁচরাপাড়া ইস্টিশন থেকে পাল্কি চড়েই তিনি এসেছিলেন বোনের শ্বশুরবাড়ি মাঝেরপাড়ায়। সেই পাল্কি অবশ্য ছিল শ্যামাচরণ দে দের। ‘গৌরাঙ্গ দেব ও কাঞ্চনপল্লী’র গ্রন্থকার অধ্যাপক সতীশচন্দ্র দে আশুতোষ মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে দেখা করেছিলেন। সেটা ছিল ১৮৯৬ সাল। তখন স্যার আশুতোষ কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের সেনেট ও সিন্ডিকেট সদস্য। এটাই ছিল তাঁর সঙ্গে কাঁচরাপাড়াবাসী অধ্যাপক সতীশচন্দ্র দের প্রথম সাক্ষাৎ। সে সাক্ষাতে স্যার আশুতোষ তাঁকে জানিয়েছিলেন, ” তোমাদের পাল্কিতে চড়িয়া আমি স্টেশন( কাঁচরাপাড়া) সতীশের(ভগ্নিপতির) বাটিতে গিয়াছি এবং পুনরায় স্টেশনে আসিয়াছি।”
(এই অংশটি ‘গৌরাঙ্গদেব ও কাঞ্চনপল্লী’ বই থেকে উদ্ধৃত)
আশুতোষ মুখোপাধ্যায়ের ইয়া গোঁফ এবং আকৃতি দেখে বেহারাদের গোঁফ ও দেহের আকার লজ্জা পেয়েছিল কি না তা অবশ্য সতীশচন্দ্র দে তাঁর বইতে লিখে যাননি।
একটি ঐতিহাসিক ঘটনার উল্লেখ না করলে লেখাটি এগুচ্ছে না বলে মনে হচ্ছে। স্যার আশুতোষ মুখোপাধ্যায়ের ছিল এক আশ্চর্যজনক লাইব্রেরি। সংগৃহীত বইয়ের সংখ্যা ছিল ৮৭,৫০০। ভাবা যায়? লাইব্রেরিতে কত সংখ্যক আলমারি ছিল বা বইসমূহ তিনি কিভাবে রক্ষণাবেক্ষণ করতেন তাও এক বিস্ময়!
পরবর্তীতে ন্যাশানাল লাইব্রেরিতে তাঁর সমস্ত গ্রন্থ নিয়ে সম্পূর্ণ পৃথক একটি সংগ্রহশালা তৈরি করা হয়।
এসবই কাঁচরাপাড়ার ক্ষেত্রজ ইতিহাস। আমাদের গর্বের অনন্য উপাখ্যান।