অবতক খবর,১৩ অক্টোবর,অয়ন চ্যাটার্জী: বাঙালির বারো মাসে তেরো পার্বণ অর্থাৎ সেই জন্য কলকাতার আরেক নাম দ্য সিটি অফ জয় এক কথায় আনন্দের শহর এবং ১২ মাসে ১৩ পার্বন গুলির মধ্যে দুর্গাপুজোর উদযাপনটা অন্যতম, এবং দুর্গাপুজোর ৫ দিনের জন্য প্রত্যেক বাঙালি ৩৬৫ দিন অপেক্ষা করে থাকে এটা বলা যেতে পারে দুর্গাপুজো বাঙালির একটা আবেগ।

কলকাতায় থিম পুজো খুব বিখ্যাত এবং সেই থিম পুজোয় বিভিন্ন ধরনের ইতিহাস প্রকৃতি পরিবেশের ভাবনাকে তুলে ধরা হয়। তার মধ্যে দমদম পার্ক তরুণ দল ক্লাবের পুজো অন্যতম।

এবছর ২০২৪ এ দমদম পার্ক তরুণ সংঘ ক্লাবের থিম “সাদা আর নীল” এবং থিমটির ভাবনায় শিল্পী প্রদীপ দাস ।
সাদা বলতে এখানে বোঝানো হয়েছে মসলিনের তৈরি বস্ত্রকে এবং কথায় আছে মসলিনের সুতো হাওয়া দিয়ে তৈরি অনেকের ধারণা কারণ একটি মসলিনের সুতো অত্যন্ত নিখুঁত যে একটি আঙুলে পড়ে থাকা আংটির এপার ও ওপার হতে পারে।
আজ থেকে প্রায় ১৬০০ শতাব্দী আগে ছিল মুঘল সাম্রাজ্য এবং সেই সময় মসলিনের তৈরি বস্ত্র ছিল খুব জনপ্রিয় । তখনকার সময় বেগমেরা মসলিনের নিখুঁত কাপড় দিয়ে নিজেদের সজ্জিত করত, এর সূক্ষ্ম সুতো দক্ষ কারিগরদের হাতে বোনা হত।

শহীদ আলীর ঢাকা সম্রাট জাহাঙ্গীর এ মসলিন সম্পর্কে কাব্যিক বর্ণনা শিল্পের প্রতি তার পরিমার্জিত স্বাদ এবং ভালোবাসা সহ মসলিমের অলৌকিক সৌন্দর্যের মন্ত্রমুগ্ধ হয়েছিলেন।

সেই সময়ের বিখ্যাত মুঘল সম্রাট শাহজাহানের পুত্রী জাহানারা বেগম মসলিনের তৈরি বস্ত্র পড়ে আদালতে হাজির হয়েছিলেন যা এত সূক্ষ্ম ছিল যে বস্ত্রটি প্রায় অদৃশ্য ছিল , এবং জাহানারা পিতা তার পুত্রীকে ওই অবস্থায় দেখে বিশ্বাস করেছিলেন তিনি পরিহিত ছিল না তারপর তাকে তিরস্কার করা হয়।

জাহানারা বেগমের দাবি তিনি জে মসলিনের তৈরি বস্ত্র ধারণ করেছিলেন সেই মসলিন হল বিশ্বের সেরা মসলিন , যা বাংলার তাঁতিদের অতুলনীয় দক্ষতার প্রমাণ এবং মুঘল সাম্রাজ্যের সময় মসলিনের তৈরি বস্ত্র একটি মূল্যবান পণ্যে পরিণত হয়েছিল, যা বাংলার কেন্দ্রস্থল থেকে মধ্যম মধ্যপ্রাচ্য, ইউরোপ এবং এর বাইরে ও গহনা ও মসলার জন্য বাণিজ্য করত। গঙ্গার তীরে অবস্থিত মুশিদাবাদ একটি প্রাণবস্ত কেন্দ্র প্রতীক হয়ে উঠেছিল যা যুগ যুগ ধরে টিকে আছে।

মসলিনের সুতো সূক্ষ্ম হবার কারণে অতীত এবং বর্তমানেও ২০২৪ সালে জাদুকরদের জাদু দেখাতে ব্যবহৃত হয়।

এবং নিল বলতে নীল বিদ্রোহ কে তুলে ধরা হয়েছে…..

যখন ১৮৫০ খ্রিস্টাব্দে সময় ধীরে ধীরে মুঘল সাম্রাজ্য থেকে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যে পরিণত হয় । প্রত্যেক ইংরেজের নজর ছিল বাংলা এবং তখনকার সময় নিলের ব্যবহার পোশাকের ক্ষেত্রে ব্যবহৃত হতো। যেই জমিতে নীলের চাষ করা হয় সেই জমির মাটি বিষাক্ত হয়ে ওঠে ,ফলে ইংরেজরা জোর করে বাংলার কৃষকদের তাদের চাষের জমিতে অতিরিক্ত অর্থের দেওয়ার প্রলোভন দেখিয়ে চাষ করা তো, কিন্তু ইংরেজেরা তাদের কথামতো ন্যায্য মূল্যটুকু কৃষকদের দিতেন না এবং তার প্রতিবাদে নামলে কৃষকদের বাসস্থান কে ধ্বংস করে দেওয়া হতো এবং তাদের পরিবারকে অত্যাচারিত করা হতো।

এর ফলে সকল বাংলার ও তথা অন্য রাজ্যের কৃষকেরা এক হয়ে সেই তারা নীল সাহেবের বিরুদ্ধে নীল আন্দোলন করে এবং তাদের প্রত্যেক জায়গায় জায়গায় তারা নীল সাহেবদের খুটি গুলোতে আগুন লাগিয়ে সম্পূর্ণ ধ্বংস করে এবং ব্রিটিশ গভর্নমেন্ট কৃষকদের স্বাধীনভাবে চাষ করার অনুমতি দেয়।

তাই বাংলার ইতিহাসে সাদা এবং নীল নিছক রংয়ের চেয়েও বেশি সেগুলি হল আবেগ, সংগ্রাম এবং উত্তরাধিকার।
বাংলার ও বঙ্গবাসীর একদিকে শিল্পের প্রতিভা এবং আরেকদিকে অন্যায়ের বিরুদ্ধে নিজেদের অধিকারের জন্য লড়াই ও বিদ্রোহ কে দমদম পার্ক তরুণ দল ক্লাব দুর্গাপূজা ২০২৪ এর থিম “সাদা আর নীল ” মাধ্যমে শিল্পী প্রদীপ দাস তুলে ধরেছেন… এবং শিল্পী প্রদীপ দাস থিমের মাধ্যমে বোঝাতে চেয়েছে আমাদের বাংলার শিল্পের গুরুত্ব গোটা দেশ ও বিশ্বে কতটা… কারণ অনেকের ধারণা বাংলায় শিল্প নেই! তাই শিল্পী প্রদীপ দাস “সাদা আর নীল” থিমের মাধ্যমে কলকাতা ও তথা বঙ্গবাসীদের আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিল যে প্রাচীন ইতিহাসে বাংলার শিল্পের ও কৃষকদের গুরুত্ব কতখানি… যাতে বাংলা আর নিজের শিল্পের গুরুত্ব হারিয়ে না বসে তাই দমদম পার্ক তরুণ দলের ২০২৪ দুর্গা পূজার থিম “সাদা আর নীল”।